মুহ. কাওছার আলম/
ঠিক বিশ বছর পর নিমতলী রেস্তোরার বদ্ধ কেবিনটায় পড়ন্ত বিকেলের শেষ আলোয় দেখা হয় তাঁদের। দীঘল কালো চুলের সৌন্দর্য ঢাকা বহুল কাক্সিক্ষত বনলতা সেনের সাথে। শতবছরের পুরনো রঙচটা জঙধরা ল্যাম্প পোস্টের কাছেই সাইনবোর্ডের নাম মুছে যাওয়া রেস্তোরাটা যেন তাঁদের পুনমির্লনের সাক্ষী।
বিশ বছর যেন অনন্তকাল।
‘কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে!’- বলে দু’হাতে জড়িয়ে ধরার প্রবল ইচ্ছায় কুঁকড়ে যেতে যেতে বলে উঠলেন-‘আবার দেখা হলো তাহলে!’ চোখের কাজল নাচিয়ে শেষ জড়িয়ে যাওয়া মৃদুভাষায় বনলতা সেন বললেন- ‘তাহলে ভোলেননি! ভোলেননি সেই আলো আঁধারীর সন্ধ্যেটাকে? কী অপরূপ রূপকল্পে যে আমাকে ভাসিয়েছেন- তাকি আপনি জানেন? নাকি‘দু’দন্ড শান্তিই’ আপনার কাছে চির আরাধ্য, ভুলে যাওয়া আপনার রোগ?’
ভেতরে তীব্র ভাঙনের শব্দকে লুকিয়ে জীবনানন্দ দাশ চুপ করেই রইলেন। যেন বলার মতো কোন কথা নেই তার, কোন কথা ছিলনা কখনো! ভাবছেন- অধরা স্বপ্নরা জীবন্ত এক পাখি হয়ে উঠেছে। এখন আশ্রয়ের জন্য সেই পাখির কাছেই নিবেদিত তিনি।
‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায়নাকো আর’- বলেও অপেক্ষা করেছেন- সেই যৌবনবতী সন্ধ্যার পুনরাবৃত্তির জন্য।
‘কেবিনের ঘুলঘুলি দিয়ে চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে বনলতা সেনের শরীরের একাংশে। তখন আকাশে পঞ্চমীর চাঁদ উঠে গেছে। শহরের কোল ঘেষাঁ নারদের কূল ছাপিয়ে থই থই পানি। দূরে তাল-সুপারির সারি, গায়ে গায়ে লাগানো ঘর, বাঁশঝাড়, অশ^ত্থ- শিমুলের বন।
যেন ভুলোমনা চাঁদের আলো ভুল করে এসে পড়েছে।
আচমকা নীরবতা ভেঙে জীবনানন্দ দাশ বলে উঠলেন- ‘চলেন বাইরে যাই- আপনার শহরটাকে দেখি।’ যদিও আপনাকে দেখার পর আপনিই হয়ে উঠেছেন এই বুড়ো শহরের একমাত্র বাসিন্দা-আপনিই শহরের পরিচয়।
বনলতা সেন মৃদু স্বরে শুধু বললেন- তাই!
এক সময়ের জমকালো নাটোরের নিবু নিবু আলোক সজ্জার শহরে বেরিয়ে পড়লেন তাঁরা। বনলতা সেনের দীর্ঘাঙ্গী দেহে তখনো হঠাৎ চমকে উঠার জড়তা হাঁটাতেও যেন ভীর ষোড়শী প্রেমিকার লজ্জা। আর স্বভাবজাত সৌম্য জীবনানন্দ খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইলেও পারছেন না। এলোমেলো পা ফেলে হাঁটছেন। যেন ভাবালু তার আচ্ছন্ন তিনি।
পথ-ঘাট নিরিবিলিই বলা যায়। মাঝে মাঝে ঘোড়ার গাড়ি লণ্ঠন জ¦ালিয়ে চলে যাচ্ছে। হাটুরেদের কাফেলা বাড়ি ফিরছে দিন শেষে। গল্পে গল্পে মুখর তাদের চলার পথ।
ঘর-বাড়ি থেকে কুপির আলোর আভা ছড়িয়ে পড়েছে। আকাশে জোছনা আর চাঁদের আলো লুকোচুরি খেলছে। বনলতা সেনই মুখ খুললেন- তারপর, আপনার ধাঁনসিড়ি নদীটি কেমন আছে, অবিরল জল তার বুকে খেলা করে এখনো ! এখনো পানকৌড়ি, সাদাবক, মাছরাঙা আর হাঁসেরা দলবেঁধে ঘুরে বেড়ায়? আপনাকে আমার বড় হিংসে হয়! সবুজ-শ্যামলীমার সাথে আপনারকী যোগ! আমি শুধু অবাক হয়ে ভাবি- তাকি জানেন?
এমন সময়ে জ¦ল জ¦লে চোখের পথ ভোলা একটি শেয়াল যেন অবাক চোখে তাকিয়ে পথটা পেরিয়ে গেল। কোথাও একটা পেঁচা ডেকে গেল। সরাৎ করে পথের ধারে কোন একটা সরীসৃপ সরে গেল।
জীবনানন্দ দাশ শুধু চোখ তুলে তাকালেন। হ্যাঁ কিংবা না কোন উত্তরই করলেন না প্রশ্নের। অব্যক্ত থেকে গেল সমস্ত জিজ্ঞাসা। বিশ^ চরাচরে তখন কী ঘটছে তার কোন খোঁজ নেই তাঁর কাছে!
তিনি মনে মনে জপে চলেছেন-‘তোমায় ভালোবেসেছি আমি, তাই-/অন্ধকারে ঘাসের গন্ধ পাই,/কালো বেতের ফলে নিবিড় দিন/কোথায় থেকে আবার এলো ভেসে।’
কথার জবাব না পেয়ে বনলতা সেন বলে উঠলেন- আপনি বুুঝি কিছু ভাবছেন? আচ্ছা আপনি আপনার প্রিয় ধান সিঁড়ি নদী, মাঠ, কাঁশফুল, কাঁঠাল, অশ^ত্থ, জার”ল জলে ভাসা পদ্ম- সব ছেড়ে কোলকাতাকে আপন করে নিতে পারলেন- বলেই তার ভূবন মোহিনী হাসির মাদকতা ছড়িয়ে দিল।
জীবনানন্দ দাশ এবারও কিছু বললেন না। মাথা নিচু করে কুঁজো হয়ে হাঁটছেন তিনি। এ পৃথিবীর সমস্ত ভার যেন তাঁর কাঁধে। বুক চিতিয়ে যে দাড়াঁনো যায়- বাঁচার জন্য শ^াস নিতে যে মাথা তুলতে হয় তিনি যেন ভুলে গেছেন। কলকাতার কথা মনে হতেই একটা পাথর যেন বুকে চেপে বসল তাঁর। অপরিসর গলিরও পর স্যাতস্যাতে আলো বাতাস হীন দম বন্ধ গুমোট বাড়ি। নতুন পরিবেশে তিনি যেন খাপ খাইয়ে উঠতে পারছেন না। মন উচাটন হয়ে থাকে কোন কাজেই মন বসছেনা। ধারদেনা করে চলছেন ঠিক আছে; কিন্তু ঋণতো শোধ করতে হবে! আর্থিক অনটনও কম নয়। তার প্রতি প্রভু যেন কৃপন হয়ে গেছে।
অজান্তে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ^াস বেরিয়ে এলো তার।‘যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের-মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা/এই জেনে।’ তার চোখে ভাসছে মলিন হয়ে ওঠা স্ত্রী আর সন্তানের রূপ। বরিশালের ধানসিঁড়ি নদী, বগুড়া রোডের ছায়াঘেরা বাড়ির যে মায়াবী রূপ তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে, চোখের পাতা বন্ধ হলে যার ঘ্রাণ তিনি পান-তাকি তিনি ভুলতে পারেন?