অরুন কুমার বিশ্বাস :
‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম….।
বন্দে মায়া লাগাইছে পিরিতি শিখাইছে…।
কেমনে ভূলিব আমি বাচিনা তারে ছাড়া….।’
বাস্তবতা, আধ্যাত্মিকতা, দেহতত্ত্ব সমৃদ্ধ গানগুলি আজ সারা বাংলার আনাচে কানাচে কান পাতলেই আবাল বৃদ্ধ বনিতার মুখে মুখে শোনা যায়। তার গান আজ দেশ থেকে দেশান্তরে পৌঁছে গেছে। দারিদ্রতা যাকে হারাতে পারেনি সবার অন্তরে যার বসবাস। তিনি ভাটি অঞ্চলের প্রাণ পুরুষ সুরস্রষ্টা বাউল স¤
দুঃখ দারিদ্রের মাঝে বেড়ে ওঠা এ বাউল সুনাম গঞ্জের হাওর এলাকা চষে বেড়িয়েছে আর মানুষের দুঃখ দুর্দশা দেখে গান রচনা করেছেন। কিশোর বয়স থেকে মানুষের দুর্দশার গান লিখে ভাটি অঞ্চলে জনপ্রিয় হলেও মৃত্যুর কিছু পূবে দেশব্যাপি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় উজানধলা গ্রামের কালনি নদীর তীরে ১৯১৬ খ্রিঃ জন্ম গ্রহন করেন শাহ্ আবদুল করিম। পিতার নাম ইব্রাহিম আলী ও মাতা নাইওরজান প্রকৃতির ভালোবাসায় কাদা জলে মানুষ এ শিপ্লীর শিক্ষাগত যোগ্যতার বালাই নেই। জীবনে তেমন ভাবে বিদ্যালয়ের বারান্দাই পা দেবার সুয়োগ হয়ে ওঠেনি অভাব অনাটনের সংসারে যেখানে নুন আনতে পানতা ফুরায়। তাই কখনো মুদি দোকান কখনো রাখালের কাজ করেছেন গলায় সুর ছিল তাই সব সময় তার মুখে গান লেগে থাকতো। বিদ্রোহী কবি তার জীবন দর্শন থেকেই লিখেছিলেন,“হে দরিদ্র তুমি সোবে করেছো মহান….।
ভাটি অঞ্চলের প্রাণ পুরুষ সুরস্রষ্টা শাহ আবদুল করিম এর জীবন দর্শনে ও ঐ চরনভলি প্রতিফলিত হয়েছে।তবে হ্যট এই মানকটির আত্মসম্মান বোধ প্রখার ছিল। বিভিন্ন প্রতিষ্টান আর্থিক সাহায্যে এগিয়ে এলেও প্রত্যাখান করেছেন।
জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বড় হওয়া বাউল শাহ্ আব্দুল করিমের সংগীত সাধনার শুরু ছেলেবেলা থেকেই। বিবাহের পরে তার সহধর্মীনি আফতাবুন্নেসা উৎসাহ দিয়েছেন সব সময়। তাই শিল্পী স্ত্রীকে আদর করে সরলা বলে ডাকতেন, বাউল গানের দীক্ষাগুরু সাধক রশিদ উদ্দিনের কাছ থেকে তালিম নিয়ে পরবর্তীতে শরীয়ত, মারিফত, দেহতত্ত্ব নবুয়ত বেলায়েত, গণসঙ্গীত সহ অন্যান্য গান চর্চা করেছেন। ফকির লালন শাহ্, পঞ্জু শাহ, দুদ্দু শাহ্ প্রমুখ এদের দর্শন থেকে প্রভ’ত অনুপ্রাণিত হয়েছেন এ সুর সম্রাট। সৃজনশীলতা মানবতাবাদী এ শিল্পী প্রেম ভালোবাসার পাশাপাশি সকল অন্যায় অবিচার কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সাবলীল ভাবে নিজেস্ব ঢ়ং এ গান গেয়েছেন। আর এ জন্য ধর্মীয় বিধি নিষেধের কারন দেখিয়ে তাকে গ্রাম থেকে বের করে দেয় হয়েছে অনেক বার। তারপর ও তাকে সৃষ্টি থেকে বিরতি রাখতে পারেননি। প্রায় সহস্রাধিক গান লিখেছেন এবং সুরারোপ করেছেন, বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে তার ১০ টি গান ইংরেজীতে অনূদিত হয়েছে এবং এ পর্যন্ত তার ৬ টি গানের বই প্রকাশিত হয়েছে, বইগুলো হলো- আফতাব সঙ্গীত, গণ সঙ্গীত, কালনীর ঢেউ, ভাটির চিঠি, কালিনীর কুলে এবং দোলমেলা।
এই প্রতিভাধর গুনী শিল্পির ঝুলিতে রয়েছে অনেক আজীবন সম্মাননা পদক এবং ২০০১ সালে সর্বোচ্চ একুশে পদক লাভ করেন। কালে কালে মানুষের দূঃখ দুর্দশা, দেখে গান রচনা করে গেছেন। এই গানে যেমন ছিল আনন্দ, বেদনা, তেমনী ছিল জীবন সংগ্রামের প্রেরণা। আ এ সমস্ত কারনে তাকে দেওয়া হয়েছে “বাউল সম্রাটের” মর্যদা। এই প্রথিতযশা ভাবপাগল মানুষটি নিজে না কেঁদে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯ খ্রিঃ। আমরা তাঁর সৃষ্টিকুল সংগ্রামী জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।