এমএম আকাশ/
সরকার সোনালি করমর্দনের মাধ্যমে বিজেএমসির ২৫টি পাট কারখানার ২৫ হাজার শ্রমিককে ‘আগাম বিদায়’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থাৎ আপাতত কারখানাগুলোতে উৎপাদন বন্ধ থাকবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এ বছর রপ্তানিও হবে না। গত ২৮ জুন পাটমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, পরবর্তী সময়ে প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপের মাধ্যমে এগুলো চালু করা হবে। পাট কমিশনের সদস্য খালেদ রব অবশ্য মনে করেন পাটকলগুলো এভাবে একবার বসে গেলে বাজার হাতছাড়া হয়ে যাবে। তার মতে, একসঙ্গে সব বন্ধ করার এই তথাকথিত ‘শক-থেরাপি’ একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত। যে কারখানাগুলোর বৈদেশিক অর্ডার আছে সেগুলো বন্ধ না করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
বিজেএমসির দুর্নীতি-অদক্ষতা, ক্রমাগত লোকসান ইত্যাদির বোঝা সরকার আর বহন করতে রাজি নয়। দেশের অনেক বুদ্ধিমান নাগরিকও এই ফুটো কলসিতে পানি ঢালতে নারাজ। এই যুক্তিকে কেউ কেউ অবশ্য চরম পর্যায়ে টেনে নিয়ে দাবি করেন যে, রাষ্ট্রীয় খাত মাত্রই পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কারণ বাজারকে রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র দিয়ে বশ করার সব প্রচেষ্টা নাকি অতীতে সর্বত্রই ব্যর্থ হয়েছে। সে জন্যই রাষ্ট্রীয় খাতে পাট যে অলাভজনক হয়েছে তা শুধু শুধুই হয়নি। তা অনিবার্য বিষয়ও ছিল বটে। এই চরম মতের প্রবক্তারা মনে করেন ব্যক্তিগতকরণ ছাড়া পাটকলকে লাভজনক করা সম্ভব নয়। বিশ্বব্যাংকের এটাই ছিল সব সময়ই সাধারণ অভিমত। এরা ভুলে যান যে, এই বাংলাদেশেই রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানার লাভ করার দৃষ্টান্ত আছে, তেমনি ব্যক্তি খাতেও লোকসানের অনেক দৃষ্টান্ত আছে।
সরকারের মধ্যে এই অবাধ পুঁজিবাদের প্রবক্তারা সরকারের হাতে কোনো অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানই থাকা উচিত নয় বলে বিশ্বাস করেন। তাদের বিশ্বাস বর্তমানে যা করা হলো তা বহু আগেই করা উচিত ছিল; আদমজী বন্ধ করে অনেক লাভ হয়েছে, এবার এগুলো বন্ধ করেও অনেক লাভ হবে। এদের মধ্যে কেউ কেউ পারলে বিদ্যুৎ, ওয়াসা, শিক্ষা, চিকিৎসা, আইন-শৃঙ্খলাসহ সকল সেবা এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ব্যবসা ও শিল্পকে ব্যক্তিমালিকানায় দিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করে থাকেন। ১৯৯০ সালে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত মডেলের বিপর্যয়ের পর তারা এ দেশে আরও সরব হয়েছেন। এই প্রবণতাকে ‘নয়া উদারনীতিবাদ’ বলা হয়, যার শুরু হয়েছিল আমেরিকা ও ব্রিটেনের দুই লৌহমানব-মানবী রোনাল্ড রিগ্যান এবং মার্গারেট থেচারের আমলে। তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দর্শন ছিল- ‘সেই রাষ্ট্রই সবচেয়ে ভালো যা হবে সবচেয়ে ছোট।’ নোট ছাপানো, পররাষ্ট্রনীতি ও সীমানা রক্ষা ছাড়া রাষ্ট্রের হাতে অন্য কোনো দায়িত্ব থাকা উচিত নয়। যদিও অনেক আগেই রিগ্যান ও থেচার বিদায় হয়েছেন; কিন্তু তাদের উত্তরসূরিরা এখনও বহাল তবিয়তে। ট্রাম্প ও মোদি তার উজ্জ্বল উদাহরণ।
তবে করোনাকালে এই মতামতের নেতিবাচক দিকটি সারাবিশ্বে অনেক ভালোভাবে উন্মোচিত হয়ে গেছে। প্রমাণিত হয়েছে, যেসব দেশে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় খাত শক্তিশালী, সেসব দেশে করোনা সংকটকে অনেক পারঙ্গমভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে। সবকিছু বিরাষ্ট্রীয়করণ না করেও চীন-ভিয়েতনাম-কিউবার মিশ্র মালিকানার মডেলটি সফল হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা ওয়াশিংটন কনসেনসাসকে বেইজিং কনসেনসাস দ্বারা প্রতিস্থাপিত করার কথা বলতে শুরু করেছেন। পুরোনো উদারনীতিবাদীরা কিন্তু অতটা চরমপন্থি নন। তারা অনেকেই ‘কল্যাণমুখী পুঁজিবাদের’ কথা বলেন। পক্ষান্তরে ‘নয়া- উদারনীতিবাদ’ বাজার ও ব্যক্তিমালিকানাকে অ্যাবসোলিউট করে ফেলেছেন। এর ফলে অর্থনৈতিক ক্ষমতাই শুধু ধনীদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়নি, তার অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে ভোটভিত্তিক গণতন্ত্রও মানি, মাসল ও ম্যানিপুলেশনের করতলগত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে- আওয়ামী লীগের মতো একটি গণভিত্তিক দলের এ রকম পরিণতি কীভাবে হলো? অসৎ আমলা, অসৎ রাজনীতিবিদ ও অসৎ ব্যবসায়ীরা যে বর্তমানে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ঘিরে ফেলেছে, তা আজ আর বলার আপেক্ষা রাখে না। পিপিপির নামে তারা পাটকলগুলোর পরিত্যক্ত সম্পদ (বিশেষত ভূসম্পদ) যে লুটপাট করে খাবে না এর কি কোনো গ্যারান্টি আছে? এমন যদি হয় যে, ব্যক্তি খাতে পাট খাতও দাঁড়াল না, লুটপাটও বাড়ল, তখন কী হবে?
গভীরভাবে কেস স্টাডি করলে পাট খাত বিকাশের তিনটি পর্ব দেখা যায়।
প্রথম পর্ব বা ব্রিটিশ ও পাকিস্তান পর্ব :পূর্ববাংলায় নীল চাষ ও পাট চাষ হতো। এসব কৃষিপণ্য ব্রিটিশরা নিজেদের দেশে নিয়ে প্রসেস করে ভারতেই পুনরায় রপ্তানি করত। আমরা ছিলাম কাঁচামাল রপ্তানিকারক এবং তারা ছিল তৈরি পণ্য রপ্তানিকারক। ফলে আমাদের দারিদ্র্য কমেনি। পূর্ববাংলার কৃষকের রক্তে ডান্ডির জুট মিলগুলোর সমৃদ্ধি গড়ে উঠেছিল। পাকিস্তান কায়েমের পর প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সমৃদ্ধি ও ২২টি ধনী পরিবার গড়ে উঠেছে পাট থেকে উদ্বৃত্ত মূল্য আহরণ করে। এ জন্য পুরো পাকিস্তান আমলে ১৯৫৪, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০ সালে যত বড় বড় গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছিল, তার পুরোভাগে দাবিটি ছিল পাট শিল্পের জাতীয়করণ এবং সেই সূত্রে ২২টি পরিবারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের হাত থেকে অর্থনীতিকে মুক্ত করা। শুধু রাজনৈতিক মুক্তি নয়, জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য পাট শিল্পের জাতীয়করণের প্রশ্নটি তখন সামনে চলে আসে। বঙ্গবন্ধুই ছিলেন এই নীতির চ্যাম্পিয়ন। তার চীন ভ্রমণের আত্মস্মৃতি ও অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠ করলে তা অনায়াসে উপলব্ধি করতে পারবেন।
দ্বিতীয় পর্ব ১৯৭২-৭৫ : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার প্রায় ৯৫ শতাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করে। গঠিত হয় ১১টি সেক্টর করপোরেশন। কিন্তু সেখানে প্রথমেই উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার সংকট সৃষ্টি হয়। পৃথিবীতে অতীত এবং বর্তমানে বহু দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে বহু বৃহৎ কারখানা বা করপোরেশন দক্ষতার সঙ্গে চলছে। চীনের শক্তিশালী সফল রাষ্ট্রীয় করপোরেশনগুলো তার উদাহরণ। এ ছাড়া ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, ভারত, ভিয়েতনাম ও কিউবাসহ বহু দেশে নানা ধরনের ব্যবস্থাপনা মডেলে সামাজিক বণ্টনের শুভ দিকটি টিকিয়ে রেখে ব্যক্তিগত উদ্দীপনাকে নিশ্চিত করার জন্য বহু চমকপ্রদ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এসব থেকে বোঝা যায় যে, কেন্দ্রীভূত আমলাতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের বিকল্প ‘নয়া উদারনীতিবাদী মুক্তবাজার’ নয় বরং কোনো না কোনো ধরনের দেশোপযোগী প্রয়োগবাদী মিশ্র অর্থনীতিই হচ্ছে অধিকতর কল্যাণকর ও দক্ষ বিকল্প, যেমনটি আমাদের ‘৭২ সালের সংবিধানে বর্ণিত আছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় আমরা পাট খাতের জন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানা রেখেই সে রকম কোনো ইনোভেটিভ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম গড়ার দিকে অগ্রসর হলাম না। এত রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার পরেও এ খাতে গত ৪৪ বছরে মোট লোকসান হয়েছে মাত্র ১০ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা। আর খোঁজ নিয়ে দেখা যায় যে, রাষ্ট্রীয় মালিকানা অব্যাহত রেখে, শুধু বিজেএমসির মাথাভারী প্রশাসন থেকে মুক্ত হতে পারলে, বিজেএমসি পাট ঠিকমতো কিনলে, যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন হলে এবং উৎপাদন ক্ষমতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার হলে এ লোকসান হতো না।
তৃতীয় পর্ব :পাট শিল্প পুনরুজ্জীবনের অন্তত তিনটি বিকল্প প্রস্তাব এই মুহূর্তে টেবিলে ছিল। প্রথমত শ্রমিকদের সোনালি করমর্দনের মাধ্যমে পাঁচ হাজার কোটি টাকা দিয়ে বিদায় করে দেন। তাতে পাটকলগুলো আপাতত বন্ধ হয়ে যাক, কিন্তু আমরা বছর বছর ফুটো পাত্রে পানি ঢালা থেকে রক্ষা পাই। এক বছর পর ব্যক্তি খাতের হাতে কারখানাগুলো পিপিপি করে তুলে দেওয়া হোক। পিপিপির শর্ত কী হবে পাটমন্ত্রীর বক্তব্যে তা কিন্তু স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে না। যদিও এর দু’দিন পর শ্রম প্রতিমন্ত্রী শ্রমিক নেতাদের বলেছেন, এক্ষেত্রে আধুনিকায়নের নানা মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে যেমন- লিজ মডেল, জি টু জি মডেল, জয়েন্ট ভেনচার মডেল, পিপিপি মডেল ইত্যাদি। দ্বিতীয় প্রস্তাব ছিল চায়নিজদের সঙ্গে ২০১৬ সালের এমওইউ পুনরুজ্জীবিত করা হোক। চায়নিজ রাষ্ট্রীয় করপোরেশন ও বিজিএমসি যৌথ বিনিয়োগ করে কারখানার যন্ত্রপাতি, খোলনলচে বদলে ফেলুক। প্রতিটি কারখানার সঙ্গে আলাদা পারফরম্যান্স কন্ট্রাক্ট হোক। চীনের জন্য বড় অংশ রেখে বাকি পণ্য স্বদেশে ও বহির্বিশ্বে বাজারজাত করা হোক। তৃতীয়ত, কয়েকটি নির্বাচিত পাটকলে ওইসব প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক সংস্থা, ম্যানেজমেন্ট ও বিজেএমসি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পারফরম্যান্স কন্ট্রাক্ট করে নতুন কর্তৃপক্ষের হাতে ১২ হাজার কোটি টাকা দিয়ে ওই নির্বাচিত কারখানা কয়টি আধুনিকায়ন করে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হোক। পরীক্ষার দিনগুলো পর্যন্ত অন্যসব পাটকলের মধ্যে যাদের অর্ডার আছে- বিদেশে ক্রমবর্ধমান বাজার আছে তা অচালু রাখা হোক। আর চলতি জুলাই-আগস্ট মাসে পাট কেনার জন্য তাদের চলতি পুঁজি ধার দেওয়া হোক এবং পাট ক্রয়ে দুর্নীতি বন্ধ করা হোক।
দুঃখজনক হলো এই প্রস্তাবগুলো নিয়ে কোনো বিবেচনাই হলো না। এই করোনাকালে পাটকলগুলোর স্থায়ী শ্রমিকদের ১৩ লাখ টাকা থেকে ৬০ লাখ টাকার লোভ দেখিয়ে এবং আন্দোলনহীনতার সুযোগ নিয়ে এক ধাক্কায় ২৫টি পাটকল সরকার বন্ধ করে দিল। এখন কারখানাগুলো বন্ধ করে বসিয়ে রাখা হচ্ছে। পাটের বাজার আমরা হারাচ্ছি। পাট চাষি ও পাট ব্যবসায়ীরা হঠাৎ করে মৌসুমের সময় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। শ্রমিকরা বেকার হয়ে গেছেন। তাদের পাওনা দেওয়া হবে সেপ্টেম্বরের পর যখন বাজেটের টাকা বিজেএমসির হাতে আসবে। তাও কখন কতটুকু কীভাবে দেওয়া হবে সবই অনিশ্চিত। করোনাকালে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার না করে নতুন করে আমরা অনেক বেশি টাকা খরচ করে (সরকারের প্রস্তাব কার্যকর করার জন্য লাগবে পাঁচ থেকে ছয় হাজার কোটি টাকা, কিন্তু শ্রমিকদের প্রস্তাবানুসারে লাগবে মাত্র বারোশ’ কোটি টাকা) দারিদ্র্য বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা ভুলে গেলাম পাটকলগুলোর বদলি শ্রমিকদের কথা, যারা এর ফলে কোনো টাকাই পাবেন না; কিন্তু পুরো বেকার হয়ে যাবেন। আমরা ভুলে গেলাম সেসব স্থায়ী দক্ষ শ্রমিকের কথা, যারা সহসা নিজ কোয়ার্টার থেকে বিতাড়িত হয়ে মাঝ বয়সে এসে পেশা বদলাতে বাধ্য হবেন অথবা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাটকলগুলোতে অনেক কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হবেন। আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল ব্যক্তি পুঁজিপতির স্বার্থ। হায় উন্নয়ন, হায় পাট শিল্প, হায় নয়া উদরনীতিবাদ! তবে এখনও সময় আছে শ্রমমন্ত্রীর বিকল্প প্রস্তাবগুলো বিবেচনায় নিয়ে নয়া-উদারনীতিবাদের রাশ টেনে ধরার।
অর্থনীতিবিদ; অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়