রেজাউল করিম খান, নাটোর/
সিভিল বা বেসামরিক প্রশাসন, যাকে আমলাতন্ত্র বলা হয়। একাত্তরে সিএসপি (সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান) ও ইপিসিএস(ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস) অফিসারদের একটি কার্যকর ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধে ছিল। তবে এদের মুষ্টিমেয় অংশ ছাড়া অন্যদের ভূমিকা গৌরবোজ্জ্বল নয়। পাকিস্তানীদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে কিংবা মুজিবনগর সরকারের অংশ হয়ে অথবা বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে এদের নিতান্ত একটি ক্ষুদ্র অংশই সেদিন এই মহৎ কাজটি করেছিলেন। সংখ্যায় কম হলেও মুক্তিযুদ্ধকালে পশ্চিম পাকিস্তানেও অনেক বাঙালি সিএসপি-ইপিসিএস অফিসার কর্মরত ছিলেন। আবার পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসেও অনেক বাঙালি পেশাগত কূটনীতিক ছিলেন। এরা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা সত্বেও মুক্তিযুদ্ধে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন নি। লেখক অরুণ ভট্টাচার্য বলেছেন, সব মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে এদের অংশ না নেয়ার হার ৯০ শতাংশ। একাত্তরে বাঙালি সিএসপি ও ইপিসিএসদের কর্মরত প্রকৃত জনবলের তুলনায় কতজন অফিসার মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ও প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তার সঠিক তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। বিভিন্ন লেখা থেকে এসম্পর্ক যতটুকু জানা যায়, আমরা দেখি তাতে কী বলা হয়েছে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। কিন্তু এতো বড় জনযুদ্ধে জনতার বিজয় খুব সহজে আসেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে তাঁদের পূর্ণাঙ্গ সমর্থন, সহযোগিতা এবং সহায়তা প্রদান ছাড়াও সামরিক অফিসারদের সহায়তা করা এবং পরিকল্পনা মাফিক মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং একটি আইনী কাঠামোর মাধ্যমে সেই যুদ্ধকালীন সময়ে স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করে প্রশাসন পরিচালনা, সেক্টরসমূহের সাথে সমন্বয়, সহযোগিতা প্রদান, মিত্রবাহিনীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা, বৈদেশিক কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক সহায়তা অর্জন সব মিলিয়ে এক মহা কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করতে হয়েছে সকলকেই। আর এ পুরো কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনুঘটক ও সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন সেই সময়ে দায়িত্ব পালনরত মুক্তিযোদ্ধা সরকারী কর্মকর্তাগণ, যারা জেলা প্রশাসক, মহকুমা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, এস.ডি.পি.ও., ম্যাজিস্ট্রেট, সিভিল সার্জন, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন তাঁরা অর্থাৎ সিভিল সার্ভেন্টগণ। তাঁদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য ১৩ জন একাত্তরে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের নির্যাতন অথবা গুলিতে নিহত হয়েছেন। আমরা শ্রদ্ধার সাথে তাঁদেরকে স্মরণ করি- আবদুল আলী; ই.পি.সি.এস. মহাকুমা প্রশাসক রাঙ্গামাটি, কাজী আজিজুল ইসলাম; ই.পি.সি.এস. অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বরিশাল, আবুল কালাম শামসুদ্দিন; সি.এস.পি, মহাকুমা প্রশাসক সিরাজগঞ্জ, এ কে এম শামসুল হক খান; সি.এস.পি, জেলা প্রশাসক কুমিল্লা নুরুল আমিন খান; সি.এস.পি. উপসচিব কৃষি মন্ত্রণালয়, আবদুর রাজ্জাক; ই.পি.সি.এস. এস.ডি.ও পিরোজপুর, মোঃ আব্দুল্লাহ; ই.পি.সি.এস. সার্কেল অফিসার ভৈরব, সাইফুল বারী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান; ই.পি.সি.এস. ট্রেজারী অফিসার পিরোজপুর, মাখন লাল দাস; ই.পি.সি.এস. সার্কেল অফিসার মঠবাড়ীয়া, আতিক উল্লাহ্; ই.পি.সি.এস. সার্কেল অফিসার পাথরঘাটা, সুরেন্দ্র নাথ দত্ত; ই.পি.সি.এস. সার্কেল অফিসার সরিষাবাড়ী, কুদরত-ইলাহি চৌধুরী; সি.এস.পি. অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজশাহী, আবদুল হামিদ; ই.পি.সি.এস. সার্কেল অফিসার, দৌলতখান।
১৯৬৬ ব্যাচের সিএসপি ও সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা বলেছেন, “১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ পকিস্তানী সেনাদের বর্বরোচিত হামলার প্রেক্ষিতে যেসকল কর্মকর্তা ভারতে আশ্রয় নিয়ে মুজিবনগর সরকারে যোগদান করেন, তাঁদের প্রায় সবাই তখন মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন পদে কর্মরত ছিলেন। পুলিশ সার্ভিস ও ফরেন সার্ভিসের দুইএকজন ছাড়া কোনো জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা না থাকায় এরা অনেকেই সচিব পদে নিয়োগ লাভ করেন।
মুজিবনগর সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিবগণ-(কাবেদুল ইসলামের গ্রন্থ থেকে)
ক্যাবিনেট সচিব হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচ টি ইমাম), মুখ্য সচিব রুহুল কুদ্দুস, সংস্থাপন সচিব নূরুল কাদের খান, অর্থ সচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান, পররাষ্ট্র সচিব মাহাবুবুল আলম চাষী ও আবুল ফতেহ, প্রতিরক্ষা সচিব এম এ সামাদ, স্বরাষ্ট্র সচিব এ খালেক, স্বাস্থ্য সচিব এস টি হোসেন, তথ্য সচিব আনোয়ারুল হক খান, কৃষি সচিব নূরউদ্দিন আহমেদ এবং আইন সচিব এ হান্নান চৌধুরী। সা’দত হুসাইন সিএসপি মুজিবনগর সরকারের অর্থমন্ত্রী এম. মনসুর আলীর একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করেন।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল, সকাল নয়টা। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম অন্যদের নিয়ে বৈদ্যনাথতলার মঞ্চে এলেন। আশেপাশের গ্রাম থেকে কিছু চেয়ার আনা হলো। কোনটার হাতল নেই, কোনোটার পায়া নড়বড়ে। ক্যাপটেন মাহবুব ও তৌফিক এলাহী চৌধুরী তখন অনুষ্ঠানসূচি তৈরিতে ব্যস্ত। গার্ড অব অনার দেয়ার জন্য কয়েক প্লাটুন ইপিআর ও কিছু আনসার-মুজাহিদ প্রস্তুত।