মুহম্মদ জাফর ইকবাল/
পৃথিবীতে যত দৃশ্য আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে, একটি ছোট শিশু পা ছড়িয়ে সাইজে তার থেকে বড় একটা বই খুলে খুব মনোযোগ দিয়ে সেটির দিকে তাকিয়ে আছে। শিশুটি পড়তে শেখেনি, ভালো করে কথাও বলতে শেখেনি, কিন্তু তার পরও বইয়ের কোনো একটা ছবির দিকে সে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে, নিশ্চয়ই তার মাথার মধ্যে তখন কল্পনার বিশাল একটা জগৎ খেলা করে যাচ্ছে। ঠিক সে রকম, পৃথিবীর যত দৃশ্য আছে তার মধ্যে সবচেয়ে আতঙ্কের, সবচেয়ে ভয় জাগানিয়া দৃশ্য হচ্ছে যখন ছোট একটা শিশু একটা স্মার্টফোনে দ্রুত লয়ের কোনো বাজনা শুনতে শুনতে সেটির স্ক্রিনে দ্রুত পরিবর্তনশীল কোনো ভিডিওর দিকে সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে আছে। আমার বুকে তখন কাঁপুনি হয়। আমার মনে হয়, সারা দিনে কতক্ষণ এই শিশুটি স্মার্টফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে? এই শিশুটি স্বাভাবিকভাবে বড় হবে তো? আরেকটু বড় হতে হতে হঠাৎ করে তার আধো আধো বুলি থেমে তার ভেতর অটিস্টিক শিশুর লক্ষণ দেখা যেতে শুরু করবে না তো?
মানুষ যে শুধু একটা মোটামুটি বুদ্ধিমান প্রাণী না হয়ে সত্যিকারের ‘মানুষ’ হয়েছে, তার একটা কারণ হচ্ছে মানুষ বিমূর্ত (অনংঃৎধপঃ) বিষয় চিন্তা করতে পারে। বিমূর্ত বিষয়ের সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হচ্ছে লেখা ও পড়া। মানুষ অল্প কয়েকটা বর্ণ দিয়ে এমন কিছু নেই, যেটা বর্ণনা করতে পারে না, এমন কোনো চিন্তা নেই যেটা প্রকাশ করতে পারে না। একটা বইয়ের পৃষ্ঠায় কিছু চিহ্ন (যেটাকে আমরা বর্ণ বলি) দেখে আমাদের মস্তিষ্কে কত বিচিত্র ঘটনা ঘটে যায়। কখনো সেই প্রক্রিয়া থেকে আমরা কিছু একটা জানি। কখনো সেই প্রক্রিয়া শেষে আনন্দে উদ্বেলিত হই, কখনো দুঃখে ভারাক্রান্ত হই। বই নামের যে বিষয়টা এই বিস্ময়কর কাজগুলো করতে পারে, তাকে যদি আমরা গুরুত্ব না দিই, তাহলে কাকে দেব? গুটেনবার্গের প্রেস আবিষ্কার হওয়ার আগে সেই মহামূল্যবান বই পড়ার অধিকার ছিল খুবই অল্প কিছু সৌভাগ্যবান মানুষের। এখন পৃথিবীর যে কোনো মানুষ যে কোনো বই পড়তে পারে, তার পরও আমরা যদি বই না পড়ি তাহলে কেমন করে হবে। কিন্তু আমরা সবাই অবাক হয়ে দেখছি, যতই দিন যাচ্ছে বইপড়ার বিষয়টা ততই কমে যাচ্ছে।
একটা ছোট শিশু যখন প্রথম স্কুলে যায় তখন আমরা সবার আগে আশা করি সেখানে সে পড়তে শিখবে। একটা শিশুকে পড়তে শেখানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে তাকে বই পড়ে শোনানো। আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে একটা ছোট শিশু যে অক্ষরগুলো চেনে না, কিন্তু গড়গড় করে বই পড়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ শিশুর বাবা-মায়ের সেই সামর্থ্য বা সুযোগ নেই। তাই তাদের স্কুলে গিয়ে প্রথমবার এই পড়া শিখতে হয়। এখন যেহেতু সচ্ছল বাবা-মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের সরকারি প্রাইমারি স্কুলে দিতে চান না, তাদের জন্য সারা দেশে অসংখ্য কিন্ডারগার্টেন তৈরি হয়েছে, সেখানে টাই পরে ফিটফাট হয়ে যাওয়া যায়, ইংরেজিতে কথা বলা যায়, তাই সবাই সেখানেই যায়। স্কুলে গিয়ে আর কিছু শিখুক আর না-ই শিখুক সবাইকে পড়তে শিখতে হয়। যে যত ভালো পড়তে শিখবে সে তত ভালো লেখাপড়া করবে। ভালো পড়তে শেখার একটা মাত্র উপায়, সেটা হচ্ছে অনেক বেশি বই পড়া। কিন্তু বাচ্চারা স্কুলের গুটিকতক পাঠ্যবইয়ের বাইরে আর কোনো বই পড়ার সুযোগ পায় না। পাঠ্যবইগুলো যত না পড়ে, তার চেয়ে বেশি মুখস্থ করে; কাজেই সেটাকেও ঠিক সত্যিকারে পড়া বলা যায় না। যদি দেশের প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চারা পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি তাদের উপযোগী অন্য অনেক বই পড়তে পারত, তাহলে তাদের ভালো করে পড়তে শেখার একটা সুযোগ থাকত। কিন্তু সেই সুযোগ নেই। এই খুবই সহজ বিষয়গুলোও কেউ খেয়াল করে বলে মনে হয় না। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, ছোট বাচ্চাদের জন্য কারো মায়া নেই! আমি নিজের কানে একবার একজন মন্ত্রীকে প্রকাশ্য মিটিংয়ে বলতে শুনেছি যে, স্কুলে ছোট বাচ্চাদের পিটুনি দেওয়া তুলে দেওয়াটা ঠিক হয়নি। স্কুলের ছেলেমেয়েদের মার খাওয়া উচিত, তাহলে তারা ‘টনটনে’ হয়ে বড় হবে। ‘টনটনে’ বিষয়টা কী আমি জানি না, আমি শৈশবে স্কুলে মার খেয়ে বড় হয়েছি কিন্তু সেজন্য আমি নিজেকে এখনো টনটনে মনে করতে পারি না। আমাদের দেশে শিক্ষার পেছনে যথেষ্ট টাকা খরচ করা হয় না। কাজেই সরকার দেশের ৬৬ হাজার প্রাইমারি স্কুলের সব বাচ্চার পড়ার জন্য ঝলমলে বই কিনে দেবে, সেটা আমি আশা করি না। সরকারি প্রাইমারি স্কুলে আলাদা লাইব্রেরি নেই, তাদের বই কেনার জন্য আলাদাভাবে টাকা দেওয়া হয় না। তাই যখন দেখেছি সব প্রাইমারি স্কুলে বঙ্গবন্ধু কর্নার করে সেখানে বাচ্চাদের বই কেনার জন্য ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে আমি যথেষ্ট অবাক হয়েছি। অবাক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুশিও হতে পারতাম, যদি দেখতাম খবরের কাগজে এই খবরটা ইতিবাচক একটা খবর হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। তা হয়নি, খবরটা প্রকাশিত হয়েছে ১৫০ কোটি টাকা দিয়ে অস্বচ্ছ পদ্ধতিতে বই কিনে কিছু মানুষকে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ হিসেবে। অন্য যে কোনো অভিযোগ হলে অভিযোগটা সত্যি না মিথ্যা, প্রমাণ করার জন্য নানা ধরনের গবেষণা করতে হতো। এই প্রথম একটি অভিযোগের কথা পাওয়া গেল, যেটি সত্যি না মিথ্যা বের করার জন্য কোনো গবেষণা করতে হবে না। যে বইগুলো কেনা হয়েছে কিংবা কেনা হবে সেগুলোর দিকে শুধু একনজর তাকাতে হবে।
এই খুঁটিনাটি আলোচনা করার আগে আমরা একটা অন্য বিষয় বিবেচনা করতে পারি। ১৫০ কোটি টাকার পরিমাণ কত, এই পরিমাণ টাকা যদি অপচয় হয়েও যায় সেটা নিয়ে আমাদের কী খুব বেশি হা-হুতাশ করতে হবে? কারণ আমার মনে আছে একবার দেশের ৪ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাবার পর আমাদের বলা হয়েছিল, একটা দেশের হিসেবে চুরি হয়ে যাবার জন্য এই পরিমাণ টাকা কোনো টাকাই না! কাজেই হয়তো এই ‘মাত্র’ ১৫০ কোটি টাকা নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলে! কিন্তু আমি ছোট একটা হিসাব করে দেখেছি ১৫০ কোটি টাকা ৬৬ হাজার সরকারি প্রাইমারি স্কুলের মধ্যে বিতরণ করে দিলে প্রত্যেকটা স্কুল প্রায় ২০ হাজার টাকা করে পায়। তখন ১০০ টাকা দাম দিয়ে একটা বই কেনা হলে প্রত্যেকটা স্কুল ২০০টা করে বই কিনতে পারবে। (যতদূর জানি, একসঙ্গে অনেক বই কেনা হলে অনেক কম খরচে বই ছাপানো যায়।) প্রত্যেকটা প্রাইমারি স্কুলে যদি ২০০টা করে বই থাকে তাহলে সেই স্কুলের সব ছেলেমেয়ে পাঠ্যবইয়ের বাইরে আরো ২০০টা বই পড়তে পারবে! যদি সত্যি সত্যিই একটা শিশু এতগুলো বই পড়ে ফেলে তাহলে তার ভেতরে কি একটা ম্যাজিক ঘটে যাবে না? যেহেতু মুজিববর্ষকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু কর্নারের জন্য বইগুলো কেনা হবে, কাজেই বইয়ের একটা বড় অংশ হবে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কিন্তু অবশ্যই সেগুলো হতে হবে বাচ্চাদের জন্য উপযোগী করে লেখা। যদি তা না হয় তাহলে যত ভালো বই-ই কেনা হোক না কেন একটা ছোট শিশু সেই বই কোনোদিন খুলে দেখবে না। স্কুলের শেলফে সেই বই দিনের পর দিন সাজানো থাকবে, যদি স্কুলে বই রাখার শেলফ থেকে থাকে। আমরা কী সেটাই করতে চাই?
যারা ফেব্রুয়ারিতে বইমেলায় গিয়েছেন তারা সবাই নিশ্চয়ই শিশু কর্নারটি দেখেছেন। শিশুদের আনন্দ উল্লাসে মুখরিত সেই অংশটিতে যারা একবার গেছে কিংবা দূর থেকে যারা সেটি একবার দেখেছে তারা সবাই জানে ঝলমলে একটা বই দেখে একটা শিশু কতটা আনন্দিত হয়। প্রত্যন্ত একটা গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের যে শিশুটি একটা সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়তে এবং যে জীবনেও সুন্দর একটা বই স্পর্শ করারও সুযোগ পায়নি, সেরকম একটি শিশু যদি একটি নয় দুইটি নয়, ২০০টি বই স্পর্শ করতে পারে, পড়ার জন্য বাসায় নিয়ে যেতে পারে—এর চেয়ে চমৎকার ব্যাপার আর কী হতে পারে? আমরা কি আমাদের সরকারের কাছে সেটি আশা করতে পারি না? বঙ্গবন্ধুকে সম্মান দেখানোর এর চাইতে সুন্দর আয়োজন আর কী হতে পারে? সবাই জানে কিনা জানি না, মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে এর মধ্যে অসাধারণ কিছু কাজ হয়েছে, স্কুলের পোশাক কেনার জন্য প্রত্যেকটা শিশুর মায়ের মোবাইলে ১ হাজার করে টাকা পাঠানো হয়েছে (বাবার মোবাইলে নয়, মায়ের মোবাইলে!)। সরকারি প্রাইমারি স্কুলে একটা শিশু যদি শতকরা ৮৫ ভাগ দিন স্কুলে আসে তাহলেই তাদের উপবৃত্তি দেওয়া হয়। সেটাও সরাসরি মায়ের মোবাইলে! কী চমৎকার একটা বিষয়। আমরা সবসময় শুধু নেতিবাচক দিকগুলো খুঁজে বের করে সেটা নিয়ে অভিযোগ করি কিন্তু এই দেশে সীমিত বাজেটের ভেতর যে কিছু অসাধারণ ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে কতজন তার খবর রাখি?
কাজেই কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ, আরো একটা অসাধারণ কাজ করুন, বইগুলো সঠিকভাবে নির্বাচন করুন। প্রাইমারি স্কুলের একটা বাচ্চাকে অনেকগুলো বই দেখিয়ে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তারা কোন বইটি পড়তে চায়, তাহলে তারা কিন্তু সঠিক বইগুলো দেখিয়ে দেবে। একটা শিশু যে কাজটা করতে পারে, বড় মানুষ কেন সেই কাজটি করতে পারবে না?
লেখক : শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী