“বসন্তের দরজায় ভালোবাসা দিবস”

কোকিলের কুহু -তান‌ পলাশের রক্তিম আভা বলছে, ভরা বসন্ত ।কিন্তু প্রকৃতির মতিগতি বোঝা বড় ভার। পারদ কখনো নেমে যাচ্ছে কখনো বেড়ে যাচ্ছে প্রকৃতির এমন খামখেয়ালি মেজাজ। সেই চিরচেনা রূপে বসন্ত বাংলায় শেষ কবে পা রেখেছিল তা বলা মুশকিল।

প্রতিবারের মতোই বসন্তের আগমনে প্রকৃতি সেজেছে পলাশ, শিমুল অশোকে, বাতাসে মুকলিত আম্র মঞ্জুরীর সুবাস সুপ্ত পাতার মর্মর ধ্বনি। ফুলে ফুলে মৌমাছি ও ভ্রমরের গুঞ্জনে বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। বসন্ত বাতাসে সই গো, বসন্ত বাতাসে, বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ, আমার বাড়ি আসে… বন্ধুর বাড়ির ফুল বাগানে, নানান বনের ফুল/ ফুলের গন্ধে মন আনন্দে, ভ্রমরা আকুল… শীতের রিক্ততা মুছে প্রকৃতিজুড়ে আজ যেন কিসের শিহরিত স্পর্শ; সোঁদা মাটি আর বহেরা- ফুলের গন্ধ মেশানো অবাক ছোঁয়া! মন টেনে নিয়ে যায় শিমুল-পলাশ-আশোকের রক্তরাগে-তার ঝরা ফুলের গন্ধে…।

আজ পয়লা ফাল্গুন। বিপুল ঐশ্বর্যধারী ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন। পাগল হাওয়ার উত্তরীয় উড়িয়ে বনফুলের পলস্নবে, দখিন-বাতাসে শিহরণ জাগানোর দিন। উড়াল মৌমাছিদের ডানায় ডানায়, নিরাভরণ বৃক্ষে কচি কিশলয় জেগে উঠবার আভাস আর বনতলে কোকিলের কুহুতানে জানান দিয়ে যায়- আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে…। আবহমান বাংলার নৈসর্গিক প্রকৃতিতে আজ সাজ সাজ রব। হিমেল পরশে বিবর্ণ ধরায় জেগে নবীন জীবনের প্রাণোলস্নাস। নীল আকাশে সোনা ঝরা আলোকের মতোই আজ হৃদয় আপস্নুত প্রাণভরা ভালোবাসায়। ফাগুন হওয়ায় বয়ে যাবে সুর- ‘ভালোবাসি… ভালোবাসি, শুধু ভালোবাসি তোমায়’।

আজ শুধুই ভালোবাসার দিন। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। ভালোবাসা বলতে কী বোঝায়? ভালোবাসা শব্দটিকে যদি দু’ভাগ করা যায় প্রথমত ভালো এবং বাসা সম্ভবতই বাসা এসেছে বস ক্রিয়া থেকে অর্থাৎ বসে থাকা।আমরা যে ঘরে থাকি সেটাকে বাসা বলি কেন? ভালোবাসা থেকে ধারণা আসে আমরা দুজন একসাথে থাকব ইংরেজিতে গিয়ে ধরা পড়ে যাকে নারী -বিয়ে করে তাকে বলে হাসবেন্ড । হাজবেন্ডের ভেতরের শব্দ হাজ মানে হাউজ বা বাড়ি জার্মান ভাষায় যেটাকে বলা হয় হুজবান্ড যে ঘর বাঁধে বাংলায় অনুবাদ করলে যাকে আমরা বলি গৃহকর্তা।মিস্ত্রির ভাষায় ঘরামী যে ঘর তৈরি করে অর্থাৎ ভালবাসা বা বিয়ে করার উদ্দেশ্যে জীবনের শেষ পর্যন্ত যার সঙ্গে কাটাতে চাই সেটাই হচ্ছে বাসা। আর ভা অর্থ কপাল, যা প্রতিভাত হয় অর্থাৎ যার সাথে থাকা যায় প্রকাশ্যে এবং বৈধভাবে সন্তান উৎপাদন করা যায় সেটাই ভালোবাসা।।

পর্বতসম ব্যস্ততা উপেক্ষা করে ভালোবাসার পাল তোলা নায়ে আজ ভাসবো সবাই। সারাবিশ্বের মতো তারুণ্যের অনাবিল আনন্দ আর বিশুদ্ধ উচ্ছ্বাসে প্রেমের মাতাল হাওয়া বয়ে যাবে দেশময়। ভালোবাসার উৎসবে মুখর হবে ধনী-গরিব, যুবা-বৃদ্ধা, তরুণ-তরুণী সবাই। রবি ঠাকুরের গানে সুর তুলে আজ লাখো কোটি হৃদয় উঠবে গেয়ে- ভালোবাসি, ভালোবাসি, এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি, আকাশে কার বুকের মাঝে-ব্যথা বাজে,দিগন্তে কার কালো আঁখি-আঁখির জলে যায় ভাসি… ভুলে-যাওয়া গানের বাণী, ভোলা দিনের কাঁদন-হাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি। ভালোবাসার আবেগে আপস্নুত হয়ে প্রেমিক হৃদয় উঠবে গেয়ে- ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে, আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে,আমার পরানে যে গান বাজিছে,তাহার তালটি শিখো তোমার চরণমঞ্জীরে… আমার আকুল জীবনমরণ, টুটিয়া লুটিয়া নিয়ো তোমার অতুল গৌরবে। বিশ্ব ভালোবাসার উৎসবের ছোঁয়া শহরের গন্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা গ্রাম-বাংলায়।

মুঠোফোনের খুদেবার্তা, অনলাইনের ই-মেইল আর ফেসবুক চ্যাটিংয়ে প্রেমকথার কিশলয়। তীব্র সৌরভ ছড়িয়ে ফুটবে ফুল সৌন্দর্যবিভায়। প্রেমিক-প্রেমিকার সঙ্গে তালে তাল রেখে ভালোবাসার জয়গানে সুর মেলাবে স্বামী-স্ত্রী, মা-বাবা, ভাইবোন সবাই। বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠী, এমনকি সহকর্মীর মাঝেও দিনভর হবে ভালোবাসার ভাব বিনিময়। ভালোবাসা দিবস উদযাপনের ইতিহাস বেশ পুরানো। এ নিয়ে একাধিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি যে গল্পটি প্রচলিত সেটি হচ্ছে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামে একজন রোমান ক্যাথলিক ধর্মযাজকের ২৬৯ খ্রিষ্টাব্দের একটি ঘটনা নিয়ে। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামে ওই ধর্মযাজক একইসঙ্গে চিকিৎসক ছিলেন। তখন রোমান সম্রাট ছিলেন দ্বিতীয় ক্লডিয়াস। বিশ্বজয়ী রোমানরা একের পর এক রাষ্ট্র জয় করে চলেছে। যুদ্ধের জন্য রাষ্ট্রে বিশাল সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলা দরকার। কিন্তু লোকজন বিশেষ করে তরুণরা এতে উৎসাহী নয়। সম্রাটের ধারণা হলো, পুরুষরা বিয়ে করতে না পারলে যুদ্ধে যেতে রাজি হবে। তিনি তরুণদের জন্য বিয়ে নিষিদ্ধ করলেন। কিন্তু প্রেমপিয়াসী তারুণ্যকে কী নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ করা যায়! এগিয়ে এলেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। ভ্যালেন্টাইন প্রেমাসক্ত তরুণ-তরুণীদের বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু একদিন ধরা পড়ে গেলেন ভ্যালেন্টাইন। তাকে জেলে পোরা হলো। দেশজুড়ে এই খবর ছড়িয়ে পড়লে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। অনেকেই ভ্যালেন্টাইনকে জেলখানায় দেখতে যান। ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতে আসেন। কারাগারের জেলারের একজন অন্ধ মেয়েও ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে যেত। চিকিৎসক ভ্যালেন্টাইন মেয়েটির অন্ধত্ব দূর করলেন। তাদের মধ্যেও সৃষ্টি হলো হৃদয়ের বন্ধন। ধর্মযাজক হয়েও নিয়ম ভেঙে তিনি প্রেম করেন। আইন ভেঙে তিনিও বিয়ে করেন। খবর যায় সম্রাটের কানে। তিনি ভ্যালেন্টাইনের মৃতু্যদন্ড দেন। সে তারিখটি ছিল ২৬৯ খ্রিষ্টাব্দের আজকের এই ১৪ ফেব্রম্নয়ারি। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে তার প্রিয় বধূকে যে চিঠিটি লিখেন তা শেষ হয়েছিল এভাবে- লাভ ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন।

অতঃপর এই ভালোবাসার স্বীকৃতি পেতে দুই শতাব্দী নীরবে-নিভৃতে পালন করতে হয়েছে ১৪ ফেব্রম্নয়ারি। ৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে রোমের রাজা পপ জেলুসিয়াস এই দিনটিকে ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে আমাদের দেশের বিভিন্ন উদ্যান, বাংলা একাডেমির বইমেলা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, কফিশপ, ফাস্টফুড শপ, লং ড্রাইভ অথবা নির্জন গৃহকোণে একান্ত নিভৃতে চলবে প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসার অভিসার। দিনভর চলবে চকোলেট, পারফিউম, শুভেচ্ছা কার্ড, আংটি, প্রিয় পোশাক, বই কিংবা রক্তগোলাপ বিনিময়। ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে আজ ‘গাঁটছড়া’ বাঁধবে অনেকেই। সবার জীবনে ভালোবাসা আসুক এই প্রত্যাশা।

লেখক- কলিম উদ্দিন