মানবিক অবক্ষয় ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

মানুষ পরের স্বার্থে কাজ করে, এটা ভাববাদী কথা প্রত্যেকটা মানুষই নিজের কল্যাণ চায়। মানুষ আত্ম কল্যাণ করতে গিয়ে প্রতিবেশীর অকল্যান করে। মানবিকতার অবক্ষয়ের দ্বারপ্রান্তে উত্তর- আধুনিক যুগের মানুষ, দেখতে তারা মানুষ হলেও মানসিকতায় নয়।

মানুষ সামাজিক জীব তথা সমাজবদ্ধ জীব। মানুষ শব্দটি মানবতার সমার্থক ,কারণ মানুষের মধ্যেই রয়েছে মান এবং হুশ ,জ্ঞান আর ভালো-মন্দ পৃথকীকরণ বুদ্ধি। কিন্তু সেই মানুষ যখন হয়ে পড়ে আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর, সুযোগ সন্ধানী ক্ষমতালোভী, অর্থলোভী, তখনই মানবিকতার অবক্ষয় ঘটে। মানুষ নিজের স্বার্থের দ্বারাই পরিচালিত হয়। স্বার্থের দ্বন্দ্ব মানুষকে মানবতাহীন করে তোলে। মানবিকতার অবক্ষয় ধীরে ধীরে সমাজকে করে তোলে ভঙ্গুর। সমাজের প্রগতিশীলতাকে ধীরে ধীরে নষ্ট করে তোলে।

প্রশ্ন হলো মানবিকতার অবক্ষয় হয় কেন? আমরা যদি একটু অন্যভাবে দেখি। প্রথমত, প্রতিটি শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় পরিবার থেকে। পরিবার তার সদস্যদের চরিত্র গঠন করে। সন্তান পরিবার থেকে শিখতে পারে আদব-কায়দা, শ্রদ্ধাবোধ দায়িত্ববোধ, নীতি কথা, নৈতিকতাবোধ মানবিকতা বোধ প্রভৃতি, মানব জীবনের মৌলিক আদর্শ গুলি। কিন্তু বর্তমানে মানুষ নিজেদের অতীব সুখবিলাসের জন্য পরিবারের মধ্যে সৃষ্টি করছে ভাঙ্গন। আগের মতো আর যৌথ পরিবার দেখতে পায় না। যৌথ পরিবার গুলি একক পরিবারে টুকরো টুকরো করে ভেঙে যাচ্ছে। একক পরিবারের সন্তানেরা হয় আয়া, নয় ক্রেশে থাকছে। গ্রামগুলিও ছুটছে শহরের দিকে। ফলে কৃষিজীবী মানুষও আজ তাদের সন্তানের শিক্ষার জন্য শহর মুখো। শুধুমাত্র পুঁথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার ফলে শিশুরা আজ ঠাকুরদা -ঠাকুমার সেই আদর স্নেহ ভালবাসায় লালিত হচ্ছে না।

আজকের সভ্য সমাজের সন্তানেরা ঠাকুমার ঝুলি কিংবা রাজা -রানীর কাহিনী, ঘুম পাড়ানি গান শুনে বড় হয় না। শিশুদের প্রার্থিত নয় মহাপুরুষের জীবনী। আজকের সন্তানদের পরিবারে একাকীত্ব- আত্মকেন্দ্রিকতা ছোটবেলা থেকেই গ্রাস করছে। শিশুদের শৈশব বলে আর আলাদা করে কিছুই নেই। ছেলেবেলা থেকেই শিশুরা ইঁদুর দৌড়ে অংশগ্রহণ করছে । সুতরাং তাদের কাছে আগামীতে আমরা কিভাবে আশা করতে পারি এক সুন্দর ও অবক্ষয় মুক্ত ‌সমাজের? মানুষ সামাজিক জীব। ব্যক্তির যেমন চাহিদা আছে, তেমনি সমাজেরও আছে। আবহমান কাল থেকে মানুষের কাছ থেকে সমাজ সব সময় সামাজিক আচরণ প্রত্যাশা করে। প্রত্যেক সমাজে মানুষের ভদ্র- চিত আচরণ পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতি থাকে। নীতিহীন সমাজ হয় উচ্ছৃঙ্খল, বিভ্রান্তিকর ও অনিশ্চিত। নৈতিকতা মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে মানুষের মধ্যে আসছে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন। অপরাধপ্রবণতা। মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবসহ সম্পর্কের এমন নির্ভেজাল জায়গাগুলোতে ফাটল ধরেছে। ঢুকে পড়েছে অবিশ্বাস।

নৈতিকতা শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন( Moralitas )শব্দ হতে, তার থেকেই Moral বা মানবিক কথাটি এসেছে। নৈতিকতা হলো এক ধরনের মানসিক অবস্থা যা কাউকে অপরের মঙ্গল কামনা করতে এবং সমাজের প্রেক্ষিতে ভালো কাজের অনুপ্রেরণা দেয়। যেমন সত্য বলা, গুরুজনকে মান্য করা, অসহায়কে সাহায্য করা, চুরি, দুর্নীতি থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি। এগুলো মানুষের নৈতিকতার বহির্প্রকাশ। মূল্যবোধ হচ্ছে মানুষের আচরণের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারকারী ধারণা, আদর্শ বা ভিত্তি। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর আসছে চরম আঘাত। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ক্রান্তিলগ্নে সমাজরক্ষা নিয়ে চিন্তিত দেশের প্রত্যেক বিবেকবান মানুষ। যথার্থ জীবনাদর্শের অভাবে পরিবারগুলো এখন ভোগবিলাস ও পরশ্রীকাতর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা ও ধনবাদী ধ্যান-ধারণায় গড়ে উঠেছে ভারসাম্যহীন সমাজ। আমাদের আজকের সমাজ পরিচালিত হচ্ছে নৈতিকতার ভিত্তিতে নয়, বরং স্বার্থের মোহে। তদুপরি বর্তমান বিশ্বে মানুষের সঙ্গে মানুষের অসম প্রতিযোগিতা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে মানুষে- মানুষে দূরত্ব। ব্যক্তিজীবনে কমে আসছে ধৈর্যশীলতা। সামাজিক অবক্ষয় দিন দিন চরম আকার ধারণ করছে। এমন কোনো অপরাধ নেই, যা সমাজে সংঘটিত হচ্ছে না। স্ত্রী স্বামীকে, স্বামী স্ত্রীকে, মা-বাবা নিজ সন্তানকে, ভাই- ভাইকে অবলীলায় হত্যা করছে। সমাজে সুষ্ঠু বিচার না পেয়ে বাবা-মেয়ে, মা-মেয়ে চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। প্রদয় সূত্রের ত্রুটির কারণে অর্থ সম্পত্তির লোভে সমাজে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।

অন্যদিকে হতাশা, নিঃসঙ্গতা, অবিশ্বাস আর অপ্রাপ্তিতে সমাজে আত্মহননের ঘটনাও বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে মাদকাসক্তের সংখ্যা। মাদকের অর্থ জোগাড় করতে না পেরে ছেলে খুন করছে বাবা -মাকে, স্বামী খুন করছে স্ত্রীকে কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে। অন্যের সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য কিংবা কাউকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার নিমিত্তে মানুষ নিজের সন্তানকে পর্যন্ত হত্যা করছে। আর যৌতুকের কারণে নির্যাতন ও হত্যা তো নিত্যদিনের ব্যাপার। পারিবারিক বন্ধন, স্নেহ-ভালোবাসা, মায়ামমতা, আত্মার টান সবই যেন আজ স্বার্থ আর লোভের কাছে তুচ্ছ।

কেবল তাই নয়, সমাজের উচ্চবিত্তের তরুণরা অনেকটাই বিপথগামী । তারা জড়িয়ে পড়ছে খুন, ধর্ষণ ও মাদকাসক্তসহ নানা অপরাধে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষ দিন দিন প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠছে। নিজের একক কর্তৃত্ব ও জিদকে প্রাধান্য দিয়ে মানুষ প্রিয়জনকে হত্যার মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত হচ্ছে। মানুষের মধ্যে তৈরি হওয়া বিষণ্নতা ও মাদকাসক্তি সমাজের এই ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ডগুলোর জন্ম দিচ্ছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই জাতীয় ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের এক ধরনের মানসিক বিকৃতির লক্ষণ। সচেতনতা ছাড়া সমাজ থেকে এ ধরনের অপরাধ দূর করা সম্ভব নয়। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্প ও প্রযুক্তি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্বসভ্যতা। আধুনিক সভ্যতার দৌড়ে হারিয়ে যাচ্ছে প্রচলিত নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। ক্রমশই বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। নষ্ট হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা এবং ছিন্ন হচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক। অস্থির হয়ে উঠছে সমগ্র সমাজব্যবস্থা। বর্তমানে চলছে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়।

তাই এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে একযোগে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রকে যথার্থ ভূমিকা পালন করে যেতে হবে। তবে এ কথা সত্য, কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রের পক্ষেই নৈতিকতা ও মূল্যাবোধের অবক্ষয় থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে আসা সম্ভম নয়। কেননা, সমাজ বা রাষ্ট্রে অনেক গোত্র বর্ণ এবং বিশ্বাসের লোক বাস করে, এদের একজনের শিষ্টাচার অন্যজনের সঙ্গে মেলে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য তাই সর্বাগ্রে পরিবারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। অধনা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাৎসরিক বাজেটে শিক্ষা খাতকে সমৃদ্ধ করতে হবে। শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কলা -কৌশলীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা সম্পূর্ণ মানুষকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

লেখক- কলিম উদ্দিন