বাংলা ভাষার একাল সেকাল

বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে, নিকনে উঠোনে‌‌ ঝরে রোদ বারান্দয় লাগে জোছনার চন্দন। কবি শামসুর রহমানের এই কবিতায় আরো আছে, উদার বৈরিক মাঠে বাজে বাউলের একতারা নদীও নর্তকী হয়। কিংবা অতুলপ্রসাদের সেই মোদের গরব মোদের আশা আ-মরি বাংলা ভাষা। মাতৃভাষার জন্য এমন আবেগ থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আবেগ ছাড়া বাস্তবে ফিরলে পরিস্থিতি যেন অনেকটাই বদলে যায়। সেই বদলটা বুঝতে ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের কবিতার দিকে চোখ ফেরানো যেতে পারে।

বলছি ছেলের আমার বাংলা টা ঠিক আসে না মাথায়। বর্তমান সময়ের গড়পড়তা বাঙালির মানসিকতা যেন এতে প্রতিফলিত হয়েছে। তবুও আমরা বাঙালি, বাংলা ভাষাতে কথা বলি আমাদের নিজস্ব নীতি থাকলেও ইংরেজি প্রতিবর্ণী করণে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটু-আধটু লেখালেখি করতে ভালবাসি। পায়জামা ,পাঞ্জাবি বসন্তী রংয়ের শাড়ি পরে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করি ।

একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এবং উনিশে মে শিলচরে ভাষা শহীদদের স্মরণ করি। পুরুলিয়ার ভাসা আন্দোলনকে স্বভাবতই ভুলে যাই। আমরা বাঙালিরা সংখা হিসাবে বিশ্বের মধ্যে মাত্র ত্রিশ কোটি।আমাদের দেশে এই সংখ্যাটা কম বেশি ২০ কোটি। সাহিত্য সংস্কৃতি দিক থেকেও বাংলা ভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধ। আরো গর্ব হয় পৃথিবীর চিড়িয়াখানা আফ্রিকার সেই দেশ সেরেওলিয়নের দ্বিতীয় ভাষা- বাংলা, ভাবতে ভালোই লাগে। প্রাচীনত্তের দিক থেকেও বাংলা খ্রিষ্ট জন্ম থেকেও পুরনো বগুড়ার তথা পুন্ড্র নগরের পাথরের প্রমান মিলেছে। এমনকি গুপ্ত যুগেও বাংলার উল্লেখ পাওয়া গেছে তবে সেই সময় হয়তো বাঙালি জাতিসত্তা পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠেনি।

বঙ্গ প্রদেশ হাজার বছর আগে মগধের প্রশাসনিক ও ভৌগলিক এক্তিয়ারে থাকার ফলে বাংলার ভাষা হয়ে ওঠার ঊষা লগ্নে মগধই প্রকৃতির সঙ্গে সাদৃশ্য ছিল, এমনকি প্রত্ন বাংলা ভাষায় যেসব নিদর্শন। মহা মহো পাধ্যায় ওরফে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী,বসন্ত রঞ্জন রায় কিংবা রাখাল দাস ব্যানার্জির লিপি গবেষণায় উঠে এসেছে ,তাও সে মগধই প্রাকৃতির কাছাকাছি তেমনটাই মনে করা হয়। ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ বিষয়ে যে গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেছেন তাতেও এই তথ্য প্রমাণিত হয়েছে,তবুও চর্যাপদ কে প্রত্ন বাংলার প্রাচীনতম লিখিত নিদর্শন হিসেবে প্রমাণ ও অন্যান্য গবেষণায় বাংলা ভাষার প্রাচীনত্ত প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলা ভাষাকে কৌলিন্যের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির দাবি উঠেছিল। এক বিংশ শতাব্দীতে বাংলা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্থান পেয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে,কোন ভাষার অগ্রগতি নির্ভর করে ভাষার প্রতি ভালোবাসা, দায়বদ্ধতা এবং মমত্ববোধ।বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে, একে কাজের ভাষায় উন্নীত করা দরকার। পড়াশোনা গবেষণা, সাহিত্য,নাটক,চলচ্চিত্র জগতে বাংলা ঐতিহাসিকভাবেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা,বাঙালির প্রাণের ভাষা হিসেবে নিত্যদিনের সমস্ত কাজের জন্য যদি ব্যবহারিত হয়ে থাকে তবেই এই স্বীকৃতির সার্থকতা।

লেখক- কলিম উদ্দিন