নিতাই চন্দ্র রায় /
চাল বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। সাধারণ মানুষ তাদের আয়ের সিংহভাগ ব্যয় করেন পণ্যটি ক্রয়ে। দাম বাড়লে সংকটে পড়েন স্বল্প আয়ের লোকজন। চালের দামের সঙ্গে এ দেশের মানুষের রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি এবং খাদ্য নিরাপত্তা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাজারে চালের দাম সামান্য বৃদ্ধি পেলেই সরকারের বাজার মনিটরিংয়ের কর্মকান্ড বেড়ে যায়। কিন্তু কৃষক যখন ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচ তুলতে পারেন না, তার খবর সেভাবে প্রচারিত হয় না। সরকারও বিষয়টি গুরুত্ব দেয় না। সবাই ভোক্তার স্বার্থ দেখেন। কম দামে চাল চান। কেউ ভাবেন না, কৃষক কতদিন লোকসান দিয়ে এভাবে ধান বিক্রি করে সারা দেশের মানুষের অন্ন জোগাবেন?
২০১৭ সালে হাওরে আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়। চালের দাম বেড়ে দাঁড়ায় প্রতি কেজি ৫০ টাকায়। বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার চালের আমদানি শুল্ক কমিয়ে তখন শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসে। সরকারের হিসাবে সে বছর হাওরের বন্যায় সর্বোচ্চ ১০ লাখ মেট্রিক টন কম চাল উৎপাদিত হয়। অন্যদিকে শূন্য শুল্কের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বেসরকারি আমদানিকারকরা ২০১৭-১৮ সালে প্রায় ৬০ লাখ টন চাল আমদানি করে কৃষকের বারোটা বাজান। এতে ধান ও চালের দাম একেবারে কমে যায়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। এ পরিস্থিতিতে সরকার এ বছর কৃষকের ন্যায্যমূল্য দিতে প্রায় সাড়ে ১৯ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু মার্চ থেকে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ায় চালের দাম বেড়ে যায়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে চালের দাম গত এক মাসে কেজিতে দুই টাকা বেড়েছে। বাজারে মোটা চাল বর্তমানে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এক মাসে মাঝারি মানের চালের দামও বেড়েছে কেজিতে এক টাকা।
করোনার জন্য দুই মাস ধরে ত্রাণ দেওয়ায় সরকারি খাদ্য গুদামের মজুদ ক্রমেই কমে আসছে। বন্যার কারণে সামনে তা আরও কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে। চালকল মালিকরাও চুক্তি অনুযায়ী সরকারি গুদামে চাল সরবরাহ করছেন না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আবারও সরকার চাল আমদানির দিকে ঝুঁকছে। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে চালের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। বর্তমানে চালের আমদানি শুল্ক ৬৫ শতাংশ। এদিকে চালকল মালিকরা সরকারি গুদামে চাল সরবরাহ না করলেও সরকারের এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলছেন, শুল্ক কমিয়ে দিলে ২০১৭-১৮ সালের মতো নিয়ন্ত্রণহীন আমদানি হবে। প্রয়োজনের বেশি চাল আমদানি হয়ে ধান-চালের দাম কমে যাবে। কৃষক এবং চালকল মালিক উভয়ে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তারা সরকারিভাবে সীমিত পরিমাণে চাল আমদানির পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন।
দেশে চালের চাহিদা নিয়ে বিতর্ক আছে। বিতর্ক আছে উৎপাদনের প্রকৃত পরিমাণ, জনসংখ্যা এবং জনপ্রতি চাল ব্যবহারের পরিমাণ নিয়েও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে বার্ষিক জনপ্রতি চালের ব্যবহার ১৫২ কেজি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে ২০১৯ সালে দেশে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫৫ লাখ। এর সঙ্গে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও বিদেশিদের সংখ্যা যোগ করলে মোট জনসংখ্যা দাঁড়ায় ১৭ কোটি। সেই হিসাবে দেশে মোট বার্ষিক চালের চাহিদা ২ কোটি ৫৮ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন। চালকল মালিকদের মতে, দেশে এই মুহূর্তে বিদেশিসহ জনসংখ্যা ২০ কোটি। সে হিসাবে বছরে চালের প্রয়োজন ৩ কোটি ৪ লাখ টন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এবার বোরো চাল উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ২ লাখ টন, আমন মৌসুমে চাল উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৫০ লাখ টন এবং আউশ চাল উৎপাদন হয়েছিল ৩০ লাখ ১২ হাজার মেট্রিক টন। সে হিসাবে দেশে এ বছর চাল উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৮২ লাখ মেট্রিক টন, যা চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি। চাহিদা ৩ কোটি ৪ লাখ টন ধরলেও দেশে প্রায় ৭৮ লাখ মেট্রিক টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। এ অবস্থায় বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা হলে বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মুহূর্তে চাল আমদানির কোনো প্রয়োজন নেই। বাজারে যাতে কেউ সিন্ডিকেট করতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে সরকারকে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, চাল রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল যাতে কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য পান। কৃষক তার ধানের ন্যায্য দাম পেয়েছেন। কিন্তু বাজারে চালের দাম অস্থিতিশীল করে রেখেছে একটি চক্র। সরকারি গুদামে এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার সিকিভাগ চালও সরবরাহ করেননি চালকল মালিকরা। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি গুদামে চাল কিনতে আমদানিকৃত চালের শুল্ক কমানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে কৃষকের কোনো ক্ষতি হবে না। তবে মিলমালিকরা দাম কমালে এবং সরকারি গুদামে চুক্তি মোতাবেক চাল সরবরাহ করলে আমদানির প্রয়োজন হবে না। চালকল মালিকদের বক্তব্য হলো সরকার ধানের দাম যে হারে নির্ধারণ করে দিয়েছে, সে অনুযায়ী চালের দাম দিচ্ছে না। সরকার নির্ধারিত ৩৬ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করলে মিলারদের কেজিপ্রতি ৪ টাকা লোকসান হবে।
বাজার নিয়ন্ত্রণ, মজুদ বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকার চালের আমদানি শুল্ক হ্রাস করতে পারে। কিন্তু শুল্ক হ্রাসের সেই সুযোগ নিয়ে বেসরকারি আমদানিকারকরা যাতে দেশের চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণ চাল আমদানি করে কৃষকদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে, সে ব্যাপারে সরকারকে সজাগ থাকতে হবে এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া সিন্ডিকেট গঠনের মাধ্যমে যাতে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল করোনাকালীন চালের মূল্য বৃদ্ধি করে ভোক্তা সাধারণের দুর্ভোগ বাড়াতে না পারে সেজন্য নিয়মিত বাজার মূল্যায়ন ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কৃষক ও চুক্তিবদ্ধ চালকল মালিকরা কেন সরকারি গুদামে চাল সরবরাহ করছেন না, তার কারণ অনুসন্ধান করে প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যদিকে বন্যা-পরবর্তী কৃষি পুনর্বাসনকালে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ধানচাষিদের ধানের চারা, সার ও নগদ প্রণোদনা প্রদান করে আমন মৌসুমে চাল উৎপাদনের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে।
লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)
নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস লি., নাটোর