জাফর আহমদ :
মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে কম আয়ের শ্রমজীবী বহু মানুষের ছেলেমেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। শ্রমিকদের আয় কমে গেছে। বড় একটি অংশ কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। এদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনলাইনে লেখাপড়ার উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু প্রযুক্তি ব্যবহার না জানা ও বেশি খরচ হওয়ার কারণে সেখানেও লেখাপড়া করাও সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন এসব কম আয়ের মানুষ। রাজধানীর মিরপুর, সাভার ও গাজীপুরের শিল্প এলাকায় সরেজমিন খোঁজ নিয়ে এমন তথ্য জানা গেছে। দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের বড় একটি অংশের শ্রমিকরা কাজ হারিয়েছেন। যারা কাজ করছেন তাদেরও ওভারটাইম কমে যাওয়ায় আয় কমেছে। সাভারের আকবর আলী এমন একজন পোশাক শ্রমিক। যার মাসিক রোজগার নেমেছে প্রায় অর্ধেকে। অন্য অনেক শ্রমিকের চাকরি চলে গেছে। আকবর আলী কোনোমতে টিকে আছেন।
আয় কমে যাওয়ায় আকবর আলীকে অনেক কষ্ট করে চলতে হচ্ছে। দুই ছেলেমেয়ে। ছেলেটি স্কুলে যায়। ছেলের স্কুল বন্ধ। নিজে বাড়িতে ছেলেকে লেখাপড়া করাতে পারছেন না। অলাইনে লেখাপড়া শুরু হয়েছে। স্মার্টফোন কেনা বা স্মাটফোনে অনলাইন চালু করতে গেলে যে ডাটা কিনতে হয়, সংসার চালিয়ে সে টাকা বাঁচাতে পারছেন না। ফলে অনলাইনে লেখাপড়া হয়ে উঠছে না। অন্য ছেলেমেয়ে অনলাইনে লেখপড়া করতে পারলেও আকবর আলীর সন্তান লেখাপড়া করাতে পারছে না। ফলে পিছিয়ে পড়ার হতাশা কাজ করছে ছেলের মধ্যে।
আকবর আলী বলেন, অল্প বেতন থেকেই দিতে হয় ঘর ভাড়া, গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল ইত্যাদি। এ যেন জীবন নিয়ে যুদ্ধ। এর উপর সন্তানদের লেখাপড়ার চাপ। করোনার কারণে সন্তানদের লেখাপড়া ঠিকমত হচ্ছে না। অনলাইনে ক্লাস করতে ডাটা কিনতে হয়। মাস শেষ হওয়ার আগেই অনেক সময় দেনা করতে হয়। ফলে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আরও খারাপ অবস্থা গাজীপুরের বড়বাড়ি এলাকার পোশাক শ্রমিক মজনু মিয়ার। গত দুই মাস হলে চাকরি নেই। গ্রামের বাড়িতে মেয়ে তার দাদীর কাছে আছে, সেখানে এখন কোনো খাওয়ার টাকাই পাঠাতে পারছে না, লেখাপড়া তো দূরে থাক।
একই অবস্থা বিরাজ করছে পরিবহন খাতের শ্রমিকদের। ২৬ মার্চের পর থেকে গণপরিবহন বন্ধ হয়ে গেলে আয় বন্ধ হয়ে যায় পরিবহন শ্রমিকদের। একই সময়ে স্কুল বন্ধ থাকায় সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তারা খুব কষ্টে আছে, মানবেতর জীবনযাপন করছে। বর্তমানে সীমিত আকারে পরিবহন চালু হলেও করোনার কারণে যাত্রী নেই বললেই চলে। পরিবহন শ্রমিক শাহআলম বলেন, আগের তুলনায় আয় নেই। আমার পরিবারে সদস্য সংখ্যা চারজন। আমার এ অল্প আয় দিয়েই চলতে হয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে চলা কষ্টসাধ্য হয়েছে। আমার দুজন সন্তান তারা স্কুলে পড়ে। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় তাদের অনলাইনে ক্লাস করতে হয়। এ জন্য ডাটা প্যাক কিনতে হয়। অল্প আয় দিয়ে প্রতিদিন ডাটা প্যাক কেনা সম্ভব নয়। একদিন ক্লাস করলে পাঁচ দিন করা হয় না। এ অবস্থায় সন্তানদের লেখাপড়া নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
অনলাইনের লেখাপড়া খরচ জোগাতে না পেলে শুধু তৈরি পোশাক বা পরিবহন শ্রমিক-সন্তানদেরই লেখাপড়া বন্ধ হয়নি। বন্ধ হয়েছে নির্মাণ শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসা, দোকান শ্রমিক, ভ্যান-রিকশা শ্রমিকসহ কম আয়ের শ্রমিকসন্তানের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। কথা হয় আশুলিয়ার রেকোরেটর শ্রমিক সুজনের সঙ্গে। সুজনের এক ছেলে স্কুলে পড়ে। সুজন বাবুর্চির কাজ করেন। বিয়ে বাড়ি ও বিভিন্ন উৎসবে রান্না করে থাকেন। করোনাকালীন কোথাও বিয়ের আয়োজন নেই বললেই চলে, নেই অন্য কোনো অনুষ্ঠানও। তাই বলে কি খরচ বসে আছে নাকি-সুজনের প্রশ্ন।
সুজন বলেন, এভাবে দিন চলতে থাকলে এক সময় না খেয়েই মারা যেতে হবে। মনে হচ্ছে শুধু চারদিকে অন্ধকার। কারও কারও জীবন যেন থমকে যাচ্ছে। সন্তানের লেখাপড়া তো দূরে থাক। এমত অবস্থায় সরকার যদি এ সব কম আয়ের মানুষের জন্য কোনো ব্যবস্থা না নেয় অনেকে অপরাধের পথ বেছে নেবে।