ফারুক আহম্মেদ জীবন /
তা- আজ প্রায় বেশ কয়েকদিন হলো খুশির বাবা গরীব আলী জ্বরে ভুগছে। বলা যায় শয্যাশায়ী অবস্থা প্রায় তার। ওষুধ কমবেশি খাচ্ছে কিন্তু জ্বর
-টা একেবারে নির্মুল হচ্ছে না। জ্বর এই কমছে তো পরক্ষণে আবার বাড়ছে। অথচ ঈদ একেবারে ঘাড়ের উপর। কোন আয়- রোজগারও নেই আজ কয়দিন। কি করবে কিছু যেনো ভেবে পাচ্ছে না গরীব আলী। জ্বরে এতো কাবু হয়ে পড়েছে যে, দেহের দুর্বলতা- র জন্য রিকশাটাও নিয়ে রোডে বেরুতে পারছে না সে। আসলে বয়স যে তার খুব বেশি তা-নয়। চল্লিশ ছুঁইছুঁই এরকম হবে।কিন্তু খুব ছোট বেলায় সে- বাবা- মাকে হারিয়ে। দু, মুঠো খাবারের জন্য ঐ-টুকু বয়স থেকে রিকশার হাতল
ধরে জীবনের সাথে সংগ্রাম করতে গিয়ে কঠিন পরিশ্রম করে আজ এমন রোগগ্রস্ত হয়ে গেছে।
ঢাকার গুলশান বস্তির ভাঙ্গাচুরা ছোট্ট একটা কুঁড়েঘরের বারান্দায় শুয়ে শুয়ে ঈদের খরচা নিয়ে নানান সাতপাঁচ ভাবছে গরীব আলী। বিশেষ করে তার ৭/৮ বছরের ছোট্ট মেয়ে খুশি মা-ার কথা। বছরের প্রথমে একটা ঈদ। অথচ মেয়েটা যে ঈদের দিন পরবে এখনো পর্যন্ত তাকে একটা নতুন জামাও কিনে দিতে পারিনি গরীব আলী।
সে অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আজ কয়দিন তার
বউ ভাগ্যবতী সংসার চালাতে একটা ধনী লোকের বাসাবাড়িতে কাজ করছে।
নিঃশ্বাস ছেড়ে গরীব আলী মনে মনে বলে উঠলো হুম ভাগ্যবতী….
দুর্ভাগ্যবান যার স্বামী…সে ভাগ্যবতী হয় কিভাবে?
কে -যে আমার বউটার নাম ভাগ্যবতী রেখেছিল?
যাকে বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত পরনের শাড়ী
কাপড় আর পেটের দু, মুঠো ভাত ছাড়া আমি কিছুই দিতে পারিনি।
“আসলে অর্থহীন কোন নিঃস্ব গবীব দুঃখী অভাবী পুরুষদের কোন নারীর স্বামী হওয়ার, কিম্বা কোন সন্তানের বাপ হওয়ার, বাবা ডাকটুকুও শোনার বুঝি কোন অধিকার থাকেনা।”
কি করে থাকবে? স্ত্রী সন্তানদের সামান্য চাওয়াটুকু
যদি না পূরণ করতে পারে সে পুরুষ..?
এসবকিছু ভাবতে ভাবতে গরীব আলীর নিজের
অসহায়ত্বের জন্য বুকভরা কষ্টের একটা দীর্ঘ শ্বাস
যেনো বুকের পাঁজর ভেদ করে বেরিয়ে এলো।”
সম্বিত ফিরে পেলো মেয়ে খুশির ডাক শুনে। খুশি হন্তদন্ত হয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বলছে ও বাবা…বাবা…একটু উঠে বসো তো । গরীব আলী বললো কেনো-রে মা? আর তুই অমন হাঁফাচ্ছিস কেনো? কোথা থেকে এলি? তারপর পিছনদিকে তাকিয়ে দ্যাখে এক ভদ্রলোক ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। উনি…উনি..কে-রে মা?
খুশি বললো এজন্যই তো তোমাকে একটু উঠতে
বলছি বাবা..। উনি একজন ডাক্টার। তোমাকে দেখানোর জন্য ডেকে এনেছি। কিন্তু মা..।হাতে যে
কোনো টাকা পয়সা নেই এ অবস্থায়…। খুশি বাবা
বলে কথা বলতে যাবে…তখন ডাক্তার দয়াল চাঁদ
বলে উঠলো ওসব নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে
হবে না। আপনার এইটুকু মেয়ে…আপনার মেয়ে
তো না, যেনো সাক্ষাৎ মা। খুশির বাবা গরীব আলীর দু, চোখে টলমল করছে। ছলছল চোখে
মেয়ে খুশিকে কাছে টেনে সারা মাথায় গায়ে স্নেহের হাত বুলাতে বুলাতে বললো, আপনি ঠিকই বলেছেন ডাক্তার সাহেব, ও আমার মেয়ে হলেও, ও যে আমার মা। সেসময় খুশির মা পিছন দিক থেকে এসে ডাক্তারের পাশ কেটে সামনে এলো। গরীব আলীর চোখে জল ছলছল করছে।
অচেনা একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। এসব দেখে ভাগ্যবতী বললো কি ব্যাপার! উনি..উনি কে মা খুশি? খুশির কথা বলার আগেই, খুশির বাবা চোখের জল মুছতে মুছতে বললো উনি ডাক্তার বউ। দ্যাখো তোমার মেয়ের কাণ্ড। তোমার মেয়ে আমার জন্য ডাক্তার ডেকে এনেছে। ডাক্তার…তা- মা খুশি উনাকে একটু বসার দিসনি কেনো? ডাক্তার দয়াল চাঁদ বললো। আমার জন্য আপনাকে ওতো ব্যস্ত হতে হবেনা। তাই বললে হয়। তারপর দ্রুত ঘর থেকে একটা চৌকি এনে ডাক্তার কে বসতে দিল ভাগ্যবতী। চৌকিতে ডাক্তার বসতে বসতে বললো জানেন আপনাদের
ঐটুকু মেয়ে আজ কি করেছে? আমার চেম্বারের সামনের রোডে ফুল বিক্রি করছিল খুশি। শুনে গরীব আলী ভাগ্যবতী দুজনেই বিস্মিত ভাবে মায়ার চোখে তাকালো মেয়ের দিকে। তারপর ডাক্তার কল্পনা করে বলতে লাগলো আমি রুম
থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠবো তখন খুশির কাছ
থেকে ফুল কিনে টাকা দিতে গেলে ও বললো
আপনি কি ডাক্তার.? আমি বললাম হ্যা কেনো..?
খুশি বললো আমার ফুলের টাকা দিতে হবে না।
আপনি তো ডাক্তার মানুষের অসুখ সারান। দয়া করে একটু চলুন না আমার সাথে। আমার বাবা খুব অসুস্থ। আমরা খুব গরীব, ডাক্তার দেখানোর
টাকা নেই। তারপর চলুন না, চলুন না,বলে বলে আমার হাত ধরে টানাটানি করতে লাগলো। খুব
মায়া হলো আমার। তাই আর খুশিকে না করতে
পারলাম না। আর এসে যা দেখলাম, সত্যিই না
আসলে যে আমার অনেক বড় পাপ হত। তারপর
ডাক্তার গরীর আলীকে ভালো করে দেখে শুনে
বললো জ্বরের একটু বয়স হয়ে গেছে। অসুবিধে
নেই। ব্যাগ থেকে ওষুধ বের করে দিয়ে বললো এগুলো নিয়মিত খেলে খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে
ইনশাআল্লাহ। ভাগ্যবতী বললো কিন্তু আপনার
ওষুধের বিল? ডাক্তার বললো..আরে না, ওষুধের
কোন টাকা দিতে হবেনা। এটা মনে করুন খুশির
মুখের হাসির দাম হিসেবে বিলটা পেলাম। গরীব
আলী, ভাগ্যবতী একসাথে বলে উঠলো। আল্লাহ
আপনার ভালো করুন। ডাক্তার প্রশান্তির হাসি হেসে খুশিকে কাছে ডেকে বললো কি খুশি তো তুমি? খুশি মুখে হাসি এনে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলো। ডাক্তার পকেট থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে খুশির হাতে দিয়ে
বললো এটা রাখো খুশি। তুমি ঈদের জন্য জামা
কিনো কেমন? খুশি না করতেই ডাক্তার বললো
মনে করো এটা তোমার ফুলের দাম হিসেবে দিলাম। খুশি, বললো ফুলের দাম তো বিশ টাকা।
ডাক্তার বললো বাকিটা তোমার ঈদের বকশিস
মনে করো। ঈদের জন্য নতুন জামাকাপড় কিনো
ঠিক আছে..? খুশি মা- বাবার দিকে তাকাতে তারা
সম্মতি দিল নিতে। খুশি টাকাটা নিলো। ডাক্তার
খুশির মাথায় হাত দিয়ে বললো খুশি এবার তাহলে আমি আসি..?খুশি বললো আচ্ছা আবার আসবেন। ডাক্তার বিদায় নিয়ে চলে গেলো।
দু, তিন দিন ওষুধ খাওয়ার পর গরীর আলী প্রায়
সুস্থ হয়ে উঠলো। কাল ঈদ সেমাই চিনি বাজার
এসব করবে কি দিয়ে? তা- নিয়ে খুশির মা- বাবা
কথা বলছে। ঘরের দরজার ওপাশ থেকে সব শুনে খুশি তার জমানো মাটির ব্যাংকটা এনে বললো বাবা তুমি আমাকে যে মিষ্টি খেতে টাকা দিতে। আমি মিষ্টি না খেয়ে সব টাকা এই ব্যাংকে
রাখতাম। ভেঙ্গে দ্যাখো এ টাকায় তোমার লুঙ্গি
মায়ের শাড়ী আর আমাদের ঈদের জন্য সেমাই
চিনি অন্য বাজারও হয়ে যাবে। ভাগ্যবতী আর গরীব আলী মেয়ের কথা শুনে দু,জন দুজনের
দিকে তাকাতাকি করতে লাগলো। গরীব আলী
বললো কিন্তু মা.. ভাগ্যবতী বললো ঠিক আছে বলছে যখন নাও। তুমি আবার একটা তোমার মেয়ের জন্য মাটির ব্যাংক এনে দিও। সেই ব্যাংকে
আবার খুশি টাকা জমাবে। খুশি বললো, মা, ঠিক
বলেছে বাবা নাও। আনন্দে গরীর আলীর চোখে
আবারো জল চলে এলো। মেয়ে খুশিকে কাছে নিয়ে একটা আদরের চুম্বন দিলো গরীব আলী।
তারপর ব্যাংক ভেঙ্গে টাকা গুনে দ্যাখে এক দেড়।হাজার মত টাকা জমিয়েছে খুশি। সবার মুখে
হাসি। সে টাকা নিয়ে ভাগ্যবতী আর গরীব আলী
মেয়ে খুশিকে সাথে নিয়ে বিকেল বেলা ঈদের বাজার করতে গেলো। প্রথমে খুশির জন্য একটা
জামা-পাজামা জুতা কিনলো। তারপর খুশির মায়ের জন্য একটা শাড়ী। নিজের জন্য একটা লুঙ্গি। এরপর সেমাই, চিনি,সহ অন্য অন্য জিনিস
পত্র কিনে সব হাসি খুশি মনে বাড়ি ফিরলো।
ছোট্ট মেয়ে খুশির ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে তারপরদিন বেশ
হাসি আনন্দে ঈদ কাটলো গরীব আলী আর
ভাগ্যবতীর তাদের মেয়ে খুশি মা-কে নিয়ে।