মনির চৌধুরী /
সবুজ-শ্যামল অপার মায়ায় ঘেরা সাজুদের গ্রাম। দেখতে যেন রূপকথার দেশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি। তাদের এই সবুজ-শ্যামল গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে আঁকাবাঁকা নদী। যে নদীর বুকে শত শত মৎস্যজীবী মাছ ধরে জীবিকানির্বাহ করে। নদীর বুকে বালুচর জেগে উঠলে ফসল ফলানোর তরে কৃষক-কৃষাণি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যেখানে রাতের আকাশে মিটিমিটি তারা হাসে। রূপালী চাঁদ জোছনা ছড়িয়ে মেঘের ভেলায় ভেসে। অমাবস্যা রাতে মানমাতিয়ে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকে। গ্রামের তেপান্তরের মাঠ থেকে ভেসে আসে শিয়ালের ঐ হাঁক। রাখালিয়ার মোহন বাঁশির বিমোহিত সুর।
আর সেই সবুজ-শ্যামল অপার মায়ায় ঘেরা সাজুদের গ্রাম সম্পর্কে একবার সে তার দাদুর মুখে অদ্ভুত গল্প শুনেছিল। তাদের গ্রামটি নাকি দীর্ঘ দিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল। গ্রামের পথ দিয়ে চলতে গেলে দেখা যেত নীরব বাড়িঘর আর জনশূন্য পথঘাট। চারিদিক খাঁ খাঁ মরুভূমি। প্রথম পর্যায়ে ভূত-পেত্নীর ভয়ে নাকি সাজুদের গ্রামের সহজ-সরল মানুষ গ্রাম ছেড়ে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকায় চলে যায়।
ক্ষেত্রবিশেষ দীর্ঘ দিন পর তাদের গ্রামে পুনরায় জনবর ভেসে ওঠে। নদীর কিনারার বসাবাসের উপযুক্ত স্থান গুলোতে বিভিন্ন এলাকার মৎস্যজীবীরা পর্যায় ক্রমে এসে বসাবস শুরু করে। যার কারণে গ্রামটির বসাবসের অধিকাংশ স্থান মৎস্যজীবীদের দখলে। আর অল্প কিছু স্থান বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের দখলে। গ্রামটিতে বিভিন্ন পেশারজীবীর মানুষ থাকলেও সবাই বন্ধুর মত মিলেমিশে বসবাস করে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে আনুমানিক একশো বছর পর এই গ্রামের পুনরায় বসাবস শুরু হয়। সেই কারণে অধিকাংশ মানুষ এই গ্রামটির নাম ভুতুড়ে গ্রাম হিসাবেই চেনেন। এই গ্রামের বহু বছরের পুরোনো ঘরবাড়ি আর ধ্বংসস্তুপগুলোতে মিশে আছে রহস্যময় নানান ঘটনা আর অদ্ভুত গল্প।
ঠিক তেমনি সাজুদের গ্রামে বহু পুরানো আমলের একটা বাগানবাড়ি ছিল। বাগানবাড়িটি ছিল নদীর ধারে বিভিন্ন রকমের গাছগাছালিতে ভরা। ভূত-পেত্নীরদের বসাবসের স্থান। বাগানবাড়িতে ভূত-পেত্নীর বসাবসের কারণে কেউ কেউ বলতো ঐ বাগানবাড়ি থেকে রাতের আঁধারে কেমন যেন অদ্ভুত কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতো। আবার কেউ কেউ বলতো নূপুরের ধ্বনি ভেসে আসতো। একবার নাকি কয়েক জন জেলে সেই অদ্ভুত কান্নার আওয়াজ শুনে ছুটে গিয়েছিল ঐ বাগানবাড়িতে। কিন্তু সেদিন তারা আর বাড়ি ফিরে আসেনি।
যার কারণে সেদিন থেকে ঐ বাগানবাড়িতে কেউ রাতে আঁধারে একা একা যাওয়ার সাহস পেতো না। এমনকি সেখানে দল বেঁধে যাওয়ার উদ্বেগও নিতো না। সবাই ভাবতো ঐ বাগানবাড়িতে গেলে আমরা আর জীবিত ফিরে আসব না। অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ঐ ভূত-পেত্নীরদের কাছে মারা পড়বো। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সেদিন থেকে গ্রামবাসীর সব শ্রেণীর মানুষ ঐ বাগানবাড়িতে রহস্য খুঁজতে যাওয়া একেবারে বন্ধ করে দেয়। কিন্তু সাজু তার দাদুর মুখে অদ্ভুত ঘটনা শুনার পর তার মাথায় কুচিন্তা প্রবেশ করে। সেদিন থেকে সে মনে মনে ভাবতে থাকে, যে ভাবেই হোক একদিন ঐ বাগানবাড়িতে রহস্য খুঁজতে যেতে হবে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষের ভ্রান্ত ধারণাগুলো ভাঙাতে হবে।
এই জন্য একদিন সাজু তার দুই বন্ধু পাভেল ও অর্নবকে ডেকে বলে, “বন্ধু পাভেল ও অর্নব, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তিন বন্ধু মিলে সন্ধ্যা সময় কাউকে না জানিয়ে বাগানবাড়িতে রহস্য খুঁজতে যাবো। বাগানবাড়ির অদ্ভুত রহস্য সম্পর্কে তথ্য নিয়ে আমরা বাড়ি ফিরে আসবো।” কিন্তু সাজুর কথায় তার দুই বন্ধু পাভেল ও অর্নব কোন মতেই রাজি হচ্ছিল না। কারণ তারা জানে ঐ বাগানবাড়িতে গেলে কেউ আর জীবিত ফিরে আসে না। তারপরও সাজু ছিল নাছোড়বান্দা। সে খুব জেদি ও সাহসী। বাগানবাড়িতে যাওয়ার মন স্থির করে ফেলেছে। সে সেখানে গিয়েই ছাড়বে। এই আশা-প্রত্যাশা মনের মাঝে রেখে সাজু একদিন তার দুই বন্ধুকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বাগানবাড়িতে রহস্য খুঁজতে যাওয়ার জন্য রাজি করল।
সাজুর সিদ্ধান্ত মোতাবেক তারা তিন বন্ধু পরের দিন গভীর রাতে বাগানবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। সেদিন ছিল অমাবস্যা রাত চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পথঘাট একেবারে জনশূন্য। গ্রামের সব শ্রেণীর মানুষ নীরবে ঘুমিয়ে পড়েছে। কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই।তবু এমন পরিস্থিতির মধ্যে সাজু আর তার দুই বন্ধু বাগানবাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে থাকল। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা বাগানবাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেলো। বাগানবাড়িতে পৌঁছানোর পর প্রথমে তারা শুনতে পেলো, গ্রামবাসীদের মতো শুনতে পাওয়া রাতে আঁধারে ভেসে আসা সেই অদ্ভুত কান্নার আওয়াজ আর নূপুরের ধ্বনি। তখন সাজুর দুই বন্ধু অদ্ভুত কান্নার আওয়াজ আর নূপুরের ধ্বনি শুনে সাথে সাথে ভয় পেয়ে গেলো। এমন অদ্ভুত কান্নার আওয়াজ আর নূপুরের ধ্বনি তারা কোনদিন শুনেনি।
এই জন্য সেই মুহূর্তে পাভেল আর অর্নব ভয় পেয়ে সাজুকে বলল, “দেখ বন্ধু সাজু, আমাদের খুব ভয় করছে। কি ভয়ংকর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে ঐ পুরোনো বাগানবাড়ি থেকে। চল ভাই আমরা বাড়িতে ফিরে যায়।” কিন্তু সাহসী সাজু, পাভেল ও অর্নবকে বাড়ি যেতে দিল না। সে তাদেরকে জোরপূর্বক বাগানবাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলো।
তারপর প্রথমে যেই তারা বাগানবাড়িতে প্রবেশ করল, সাথে সাথে অদ্ভুত কান্নার আওয়াজ আর নূপুরের ধ্বনি থেমে গেলো। তখন সাজু তার দুই বন্ধুকে বলল, “দেখলিতো বন্ধু পাভেল ও অর্নব, আমরা এখানে আসার সাথে সাথে অদ্ভুত কান্নার আওয়াজ আর নূপুরের ধ্বনি কেমন থেমে গেল। তোরা তো ভীতুর ডিম! ভয় পেয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলি। চল বাগানবাড়িটা ভালো ভাবে ঘুরে ঘুরে দেখা যাক। কি রহস্য লুকিয়ে আছে এই বাগানবাড়ির ভিতরে।”
সাজু কথা মত পাভেল আর অর্নবের মনের মাঝে একটু সাহস ফিরে এলো। তারা দু’জন সাজুর পিছে পিছে বাগানবাড়িতে রহস্য খুঁজতে লাগল। বাগানবাড়িতে রহস্য খুঁজার এক পর্যায়ে সাজু দেখতে পেল একটা রুমের ভিতরে অলৌকিক আলো জ্বলছে। ঠিক যেন রাতের আকাশের ঐ অজস্র নক্ষত্রের মিটিমিটি আলোর মতো।
তখন সাজু দৌড়ে ছুটে গেলে ঐ অলৌকিক আলোর কাছে। অলৌকিক আলোর কাছে যাওয়া পর সাজু চিৎকার দিয়ে বলল, “পাভেল ও অর্নব তাড়াতাড়ি এখানে আয়। তোরা দেখে যা অলৌকিক আলোগুলো অন্য কিছু নয়, হীরা-মুক্তার দানা থেকে আলো ছড়াচ্ছে। আমার মনে হয় ঐ অদ্ভুত কান্নার আওয়াজ আর নূপুরের ধ্বনি এখন থেকেই হচ্ছে। কেউ মনে হয় এই হীরা-মুক্তার দানাগুলো পাহারা দিচ্ছে। আমাদেরকে এই হীরা-মুক্তাগুলো নিয়ে তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যেতে হবে এবং এ গুলো চড়া দামে বাজারে বেচতে হবে। আর এই হীরা-মুক্তার দানাগুলো বাজারে বেচে যা টাকা হবে, আমরা বাড়িতে গিয়ে তিন বন্ধু নিজেদের মধ্যে সমান তালে ভাগ করে নেবো।
অতঃপর সেদিন সাজু এই সব কথা বলার পর লোভে পড়ে হীরা-মুক্তার দানাগুলো যেই হাত দিল, সাথে সাথে অলৌকিক আলোর স্পর্শে সে অদৃশ্য হয়ে গেলো। সেই মুহূর্তে সাজুর অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার করুন পরিণতি দেখে পাভেল আর অর্নব ভয় পেয়ে সেখান থেকে রাতের আঁধারে পালিয়ে বাড়ি ফিরে আসল এবং পরে দিন সকালে তারা দু’জন গ্রামের মানুষের কাছে সাজুর অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ঘটনা সব খুলে বলল। তখন বাগানবাড়িতে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কেউ কেউ বলতে লাগলো, সাজু আর কোনদিন বাড়ি ফিরে আসবে না। লোভ আর কুবুদ্ধির কারণে তার অকালে জীবন হারাতে হলো। কথায় আছে, “লোভে পাপ পাপে মৃত্যু”। আর এই অতিরিক্ত লোভ-লালসা মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়।