অধ্যাপক কামরুল ইসলামের গল্প ‘বাড়ি যাচ্ছি’

আমাদের এক বন্ধুর চাচা সলেমন নবীর মতো পশু-পাখির ভাষা বুঝতেন। তিনি পশুর ভাষা যতটা বুঝতেন, তার চেয়ে বেশি বুঝতেন পাখিদের ভাষা। তিনি ছিলেন একজন সাধক এবং নদীর পাড়ে একটি চালাঘর তুলে সেখানে একাকীই বসবাস করতেন। সেই চালাঘরের চারপাশে ছিল ঝোপঝাড় আর কিছু মাঝারি গোছের আমগাছ। সেই ঝোপঝাড়ে ছিল অজস্র পাখির বাসা। সেই ঝোপের আড়ালে বনমোরগও দেখা যেত। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দের মানে জানতেন তিনি। আমরা ছোটবেলায় তার কাছে গেলে তিনি বলতেন পাখিদের নানান গল্প। ঘুঘু পাখি তার সবচেয়ে প্রিয় ছিল। দুপুরে কিংবা বিকেলে ঘুঘু পাখি ডাকলে তিনি কাঁদতেন। একদিন তিনি বললেন, তোমরা কি জানো এই পাখির ডাকের অর্থ? আমরা না সূচক জবাব দিলে তিনি বললেন, তাহলে শোন সেই গল্প। গল্পটি যেন তিনি মেঘের গোপন কোঠর থেকে টেনে আনলেন, যেন তিনি খাঁ খাঁ মাঠের রহস্য-জানালায় উঁকি দিয়ে দেখে নিলেন গল্পটির কড়িকাঠ। হঠাৎই তার চিত্তবিহঙ্গ থই থই জলে স্নান সেরে নতুন স্বরে ফুটে উঠল।

সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। বলেই তিনি সামনে বহমান পদ্মার বিস্তৃত জলরাশির দিকে তাকালেন, নদীর ওপারের কালোগ্রামের ভেতরে ঢুকে যেন তিনি ছোটবেলার আম কুড়োনোর দিনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়লেন। বলে উঠলেন- তখন ছোট ছোট গ্রাম আর কিছুটা দূরে দূরে বিস্তৃর্ণ জঙ্গল, সেই জঙ্গলে নানা কিসিমের পশু-পাখির বাস ছিল। অনেক মানুষ জঙ্গলে ঢুকে আর ফিরত না। জঙ্গলের ভেতরে দস্যুরা দল বেঁধে বাস করতো যেমন, তেমনি জঙ্গলের কিনারে কিনারে কাঠুরিয়াদেরও বসবাস ছিল। দস্যুরা গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতো। এরকমই জঙ্গলের পাশের একটি গ্রাম। হলুদিয়া গ্রাম। ছোট্ট সেই গ্রামের মানুষেরা চাষাবাদ ও কাঠ কেটে জীবিকা নির্বাহ করতো। একদিন সেই গ্রামেরই এক কৃষক কন্যা নিশি তার বাড়ির পাশের ছেলেটিকে ভালোবেসে তারা রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে পালালো। তারা ঠিক করেছিল কয়েক মাইল দূরের জঙ্গলে গিয়ে বাস করবে। তারা গিয়ে উঠল সেই বিশাল জঙ্গলের এক কাঠুরিয়ার বাড়িতে। কাঠুরিয়া তাদের সাদরে গ্রহণ করলো এবং বলল, তোমরা আমার মেয়ে-জামাই হয়ে এখানে থাকবে। কাঠুরিয়ার বাড়িতে আর কেউ থাকে না। তার স্ত্রী অন্য এক কাঠুরিয়ার সাথে পালিয়ে গেলে সে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেও বছর বিশেক আগের কথা। এখন সে আর অতীতের কথা ভাবে না। কাঠুরিয়া আর জামাই কাঠ কাঠতে যায়, মেয়েটি রান্না করে আর জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। দিন তাদের ভালোই কাটছিল।

একদিন রাতে মেয়েটি ছেলেটিকে বলল, তুমি কাল ভোরে উঠে আমাদের গ্রামের দিকে রওয়ানা দিবে রাখালের বেশে। কেউ তোমাকে যেন না চিনতে পারে। তুমি দেখে আসবে আমার বাবা-মা, তোমার বাবা-মা, আমাদের জন্য কেঁদে কেঁদে অসুস্থ হয়ে গেছে কিনা। কথামতো ছেলেটি ভোরে উঠেই যাত্রা শুরু করলো। জঙ্গল পেরিয়ে সে যখন নদীর পাড়ে এলো, দেখল, ভয়ঙ্কর কালো মেঘ ধেয়ে আসছে উত্তর থেকে। ছেলেটি ভাবলো, ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে সে বিপদে পড়বে, তাই সে মন স্থির করলো জঙ্গলে কাঠুরিয়ার ডেরায় ফিরে যাবে, যেখানে তার প্রিয়তম বন্ধু রয়েছে। তাছাড়া মেয়েটির জন্য তার দুশ্চিন্তাও হচ্ছিল। রাত হলেই নিশি তার বাবা-মা আর ভাইবোনদের মনে করে কেঁদে কেঁদে রাত পার করত। নিশির কান্না দেখে ছেলেটিও কাঁদত। ছেলেটির নাম ভুবন।

কাঠুরিয়া মেয়েটিকে কন্যা বলে ডাকে। বউ পালিয়ে যাবার পর মেয়ে-মানুষের প্রতি তার প্রচণ্ড ঘৃণা জন্মেছে। সে মানসিকভাবে অসুস্থ ও বিকৃত স্বভাবের মানুষে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তাকে দেখে তা বোঝার উপায় ছিল না। মেয়েটি তাকে বাবার মতোই মনে করে। জঙ্গলের মধ্যে অন্ধকার নেমে এলে কাঠুরিয়া অনেকটা পাগল হয়ে যায়। সে ডাকতে থাকে, কন্যা এট্টু এ ঘরে আই তো। মেয়েটি ভাবলো হয়তো লোকটি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মেয়েটি তার ঘরে আসতেই ঝড়-বৃষ্টি আরম্ভ হলো। মেয়েটি দেখলো, অন্ধকার ঘরে মাঝে মাঝে বজ্রের আলোয় লোকটিকে অচেনা লাগছে। এক ভয়ঙ্কর মুরতি নিয়ে সে মেয়েটির দিকে এগিয়ে আসলে মেয়েটি পালাতে চেয়েও পারলো না। কাঠুরিয়ার শক্ত বাহুতে সে এমনভাবে আটকে গেল যে তার আর পালানো হলো না। কাঠুরিয়া বলল, কন্যা এতো ভয় ক্যান তোর! মেয়েটি জ্ঞানহারা হলে কাঠুরিয়া তাকে বিছানায় নিয়ে গিয়ে এমনভাবে অত্যাচার করলো যে মেয়েটি মরে যাবার পর্যায়ে চলে গেল। ছেলেটি জঙ্গলের ঝড় ও বাতাস উপেক্ষা করে গাছপালা উপড়ে-পড়া পথ পেরিয়ে কাঠুরিয়ার বাড়িতে এসে যে ঘরে মেয়েটি থাকতো সেই ঘরে গিয়ে দেখলো সে নেই। ঘরের কোণে খাড়া করে রাখা কুঠারটি হাতে নিয়ে ছেলেটি কাঠুরিয়ার ঘরে গিয়ে দেখে সেখানেও কেউ নেই। ছেলেটির ভয় হলো। সে দেখলো বাড়ির উঠোনে ছোপ ছোপ রক্ত পড়ে আছে আর তার কানের একপাটি দুল পড়ে আাছে বাড়ি থেকে বাইরে যাবার রাস্তায়। ছেলেটির বুঝতে বাকী রইল না কী ঘটেছে। সে চিৎকার দিয়ে মেয়েটির নাম ধরে কেঁদে উঠল- নিশিৃ! তখন ঝড়ের বেগ অনেকটা কমে গেলেও বৃষ্টি থামেনি। ছেলেটি কুঠার হাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে মেয়েটির নাম ধরে ডাক দিতে দিতে নদীর দিকে এগোতে থাকলো।

বৃষ্টির মধ্যে দূরের পথে সে লক্ষ করলো একজন মানুষ কী যেন কাঁধে করে নদীর দিকে যাচ্ছে। ছেলেটি সেইদিকেই দৌড়াতে শুরু করলো। দৌড়াতে দৌড়াতে যখন সে কাছাকাছি এসে দাঁড়াল, কাঠুরিয়া মেয়েটিকে কাঁধ থেকে মাটিতে ফেলে দিয়ে বলল, জামাই, তোর কন্যা ঝড়ের মধ্যে বাইরে গিয়েছিল, জঙ্গলের দস্যুরা তার সর্বনাশ করে ফেলেছে। ছেলেটি তখন একবার আসমানের দিকে তাকালো তারপর মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল। এই ফাঁকে কাঠুরিয়া দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে ছেলেটি উঠে দাঁড়াল। কাঠুরিয়া বলল, জামাই আমি বাড়ি যাচ্ছি, আমার শরীরডা বেশ খারাপ। ছেলেটি কুঠার উঁচু করে যখন কাঠুরিয়ার দিকে ছুটে যাচ্ছিল তখন সে একটি লম্বা ছুরি নিয়ে ছেলেটির দিকে ছুটে আসলে ছেলেটির আকাশ-ফাটা হুঙ্কারে কাঠুরিয়া কাদার রাস্তায় পড়ে যায় আর ছেলেটি তার দেহ উজাড় করে সব শক্তি কুঠারে মিশিয়ে কাঠুরিয়ার বুকের মাঝখানে প্রথম কোপটি মারে।

অতঃপর ছেলেটি কাঠুরিয়াকে জিগেগস করে কেন সে এমন কাজ করলো। কাঠুরিয়া কোনো জবার না দিয়ে চোখ বুঁজে পড়ে রইল। ছেলেটি আরেকটি কোপে তার মাথা ও দেহ আলাদা করে ফেললে সে দেখল কাঠুরিয়ার চোখ খুলে গিয়েছে, রক্তে ও বৃষ্টির জলে চারপাশ একাকার। দেহ ছাড়া কাঠুরিয়ার মুখে জমে আছে ভয়ঙ্কর সব পশুর চিৎকার। অতঃপর ছেলেটি মেয়েটির কাছে এসে তাকে বুকে তুলে নদীর তীর ধরে হাঁটতে থাকে আর তার মনে পড়ে বরই পাকার দিনগুলো, গোল্লাছুটের মাঠ, জঙ্গলের ভাঁটফুল, একসাথে ক্যনালের নতুন জলে গামছা দিয়ে মাছ মারার কথা। ছেলেটি আকাশের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলো- নদীর জলে ভাসতে ভাসতে যেন তারা একসাথে পাখি হয়ে উড়ে যেতে পারে। ছেলেটি মেয়েটিকে কাঁধে করে জলে নেমে আস্তে আস্তে গভীরে যেতে থাকলে সে দেখলো দুপুর বেলার ঝকঝকে আকাশ, একটি ছোট পাখির মতো মেঘ তাদের মাথার ওপর। নদীর গভীরে এসে ছেলেটি দেখলো মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটি বলল, নিশি, দেখো আর একটু পরে আমরা পাখি হয়ে একসাথে উড়ে যাবো। মেয়েটি ঘুম ঘুম চোখেই একটু হাসলো। অতঃপর তারা দুটো সুন্দর ঘুঘু পাখি হয়ে জল থেকে উড়ে নদীপাড়ের একটি বাবলা গাছে এসে বসলো। অতঃপর সাধু বাবা চোখ বন্ধ করলেন। কিছুক্ষণ পর যখন তাকালেন তখন তাঁকে আমাদের অন্য মানুষ মনে হলো।

এই গল্প শুনতে শুনতে আমরা কেঁদে ফেলে আবার আনন্দিতও হলাম। সাধু বাবা বললেন, ওরা আর কখনো বাড়ি ফেরেনি। দ্যাখো বাড়ি থেকে একবার বেরোলে আর যে ফেরা যাবে, সেকথা বলা যাবে না। এই সাধু বাবাও আর বাড়ি ফেরেনি। তিনি বললেন, আমরা কি জানি কোথায় আমাদের বাড়ি? ওই যে ওই ঘুঘুরা তাদের বাড়ির ঠিকানা ভুলে গেছে। কোথায় ফিরবে তারা! ওদের ওই কষ্টের কথা মনে হলে আমি কাঁদি। ওরা ডুকরে ডুকরে কাঁদে প্রতিদিন, কজন বুঝে ওদের কান্নার মানে! তাই বলেই সাধু বাবা কেঁদে ফেললেন। আমরাও কাঁদলাম। আমাদের কান্নার পাশ দিয়ে শুকনো পাতারা উড়ে উড়ে চলে গেল দূরে, পাতাদের সেই উড়ে যাওয়ার মধ্যে গাছের কান্নার মৃদু ধ্বনিগুলো শুকনো ধুলোয় ভর দিয়ে জেগে আছে যেন। সাধু বাবা বললেন, দেখো, ওই পাতারা আর ঘরে ফিরবে না। ওই যে জল ছুটে চলেছে, ওই যে ঢেউগুলো, ওরা আর বাড়ি ফিরবে না। বাড়ি ফিরবে না ওই যে আকাশের উড়ে যাওয়া মেঘ।

**

একদিন নদীভাঙনের সময় তিনি সত্যিসত্যি পাড় থেকে লাফিয়ে গভীর জলে ডুব দিলেন, কিন্তু তিনি জল থেকে আর উঠলেন না। কোথাও তার লাশ পাওয়া গেল না। এই সাধক এখন কোথায় আছেন, আমরা জানি না, কিন্তু তার নিজেকে হারানোর এই শক্তিটা-ই তাকে আমাদের আলাদা করে ভাববার প্রেরণা দিয়েছে। সাধকদের ইতিহাসে তার কোনো নাম থাকবে না, সেই থাকাটাও তিনি হয়তো চাননি কখনো, কিন্তু জীবন ও জগতের রহস্যময়তার উপান্তে নির্মোহ হারানোর ব্যাপ্তিকে আমরা অন্তত খাটো করে দেখছি না। তিনি কি তাহলে পাখি হয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে কেঁদে বেড়াচ্ছেন? আবারও মনে হলো, যদি পাখি হয়ে থাকেন, তাহলে কী পাখি হলেন তিনি? একটি বিস্তৃর্ণ সুরের মধ্যে একদিন আমরা ঢুকে পড়ি, আমাদের ঢুকে পড়তে হয়- সুরটি একদিন মিলিয়ে গেলে অসুরের আগমন হয় এবং মন্ত্রপড়া বাতাসের মতো মানুষও ভেসে ভেসে চলে যায় জীবনের সীমাহীন কিনার ঘেঁসে অন্যত্রে, অন্য কোনো দুর্গত মহল্লায়ৃ সে কি জানে সেই মহল্লার নাম কিংবা সেই মহল্লার চারদিকের জঙ্গলে কোন কোন পাখি এসে গান গেয়ে ফিরে যায়?

গানের ভেতরে প্রাণের ভেতরে কে যেন ডাক দিয়ে যায়, কে যেন বলে ওঠে- এই দিকে তোমার পথৃ আমার পথের দুধারে সারিবদ্ধ মাকড়সার জাল এক টুকরো পলোনিয়াম লুকিয়ে রেখে সমুদয় দুপুরকে কব্জা করে রেখেছে। তবুও বেজে যায় গান, হয়তো বাজে না, হয়তো জীবনই নেই এই মুহূর্তে, তবু গান থাকে, গান তো থেকেই যায় আঁধারে কিংবা আলোয়। আমি অবিরাম স্বপ্নদৃশ্যের সংকেত ইশারায় কান পাতি। একটি শূন্য গহ্বরের কাছাকাছি আমার পিতার মাথার খুলির প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। ওখানে আমি দাঁড়াই। ঝরঝরে বালির ওপর আমার ছায়া পড়ে। অতঃপর ছায়াটি তরঙ্গ হয়ে বয়ে যেতে থাকে আমারই রক্তনালিতে, শিরায় শিরায়। খুলির ভেতরে বাতাস ঢুকে একধরনের মিউজিকের অবতারণা হয়। সেই মিউজিকের ভেতর আমি কোনো এক অচেনা পাখির ডাক শুনি, যেখানের ছোট্ট নদীতে একদিন মাছেদের মিছিলে কারা গুলি চালিয়ে হত্যা করেছিল নিরীহ কিছু মাছ- সেই মাছেদের আর আমি দেখি না কোনো মাছের হাটে কিংবা আড়তে। গল্পের কোরকে বাসা বাঁধে আমার মন- সেই বাসাতে খঞ্জনি হাতে একটি ছায়া এসে হাজির হয়- ছায়াটি পৃথিবীর সমস্ত গাছগাছড়ার নির্যাস মেখে আওড়াতে থাকে দূরকালের মন্ত্র- সেই মন্ত্রগুলোই ধার নিয়ে একদিন আমি বসে যাই নিরিবিলি পথেৃ।

বাড়ি যাচ্ছি, শৈশবের নিস্তরঙ্গ দাঁড় টেনে টেনে বাড়ি, যাচ্ছি-

যেন কোনো বাবুই পাখি সন্ধে ঠোঁটে ঘরে ফিরছে, সেই পথে আমিও; বিষাদ বেণী-দোলা কিশোরীর চোখের আলোয় পথ চিনে চিনে ফিরে যাচ্ছি নিজের বাড়িতে- ভিজতে ভিজতে চলে যায় স্মৃতি সব, আমাকেও ভেজায় কটি বেগানা পালক, বাতাসেরা জেনে গেছে, জেনে গেছে মেঘেরাও, ফিরে যাচ্ছি নিজের বাড়িতে- সাথে আছে ফ্রেমেবাঁধা মানচিত্র আর কিছু প্রবীণ নিদ্রার উথালপাতাল ঢেউ; বাড়ি যাচ্ছি ভাঙা পাড় দিয়ে হেঁটে হেঁটেৃ বাড়ি যাচ্ছি, বাড়ি যাচ্ছি, বাড়ি যাচ্ছি- কোথায় আমার বাড়ি?

***

ভিটেমাটি ভেঙে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পর একদিন সন্ধ্যায় যখন গ্রামে পৌঁছলাম, দেখলাম আমার বাড়িটি যেখানে ছিল, সেখানে প্রবল স্রোতের সোঁ সোঁ শব্দ। ধুলোর সেই রাস্তাটিও গ্রাস করেছে সর্বনাশা নদী। দুচোখ ভিজে গেল জলে। আমি তখনো জানি না আমার মা, ভাইবোনেরা কোথায় আছে। গ্রামের মানুষেরা নদীর পাড় থেকে বেশ কিছুটা দূরে কোনো এক নতুন জায়গায় আবার সবাই মিলে নতুন পাড়ার পত্তন করেছে শুনেছি, কিন্তু তখনো সেই নতুন পাড়াটি আমার দেখা হয়নি। বন্ধু সালেহ আহাম্মদ তার মোটর বাইকে করে আমাকে নদীর পাড়ে নামিয়ে দিয়ে চলে এসেছে অনেক আগেই। হাঁটতে থাকি। একাকীই। চেনা-জানা পথগুলোও সব অচেনা মনে হয়। সন্ধ্যার অন্ধকারে আমগাছতলে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার বাড়িটি কোথায়? আমার এ আহাম্মকী প্রশ্ন শুনে ছেলেটি কিছুটা অবাক হয়েই উত্তর দিল, ‘পাগল নাকি, নিজের বাড়ি চেনে না! মনটা আরো খারাপ হলে আকাশের দিকে তাকাই। অজস্র তারার মৃদু আলোয় আমি দেখি, আমার ছেলেবেলার সেই চঞ্চলতা, মধুময় দিনগুলো অন্ধকারে নিমজ্জিত বাঁশঝাড়ের মাথা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে নামছে। আমি আমার বাল্য বন্ধুদের ছায়া দেখি কিছুটা দূরে।

বাঁশঝাড়ের ওপাশেই রহিম পাইনির বাড়ি। ছোটবেলায় কোনো কোনো দিন দাদাজানের সাথে হাটে যেতাম। দাদাজান সন্ধ্যায় যেতেন এজন্যে যে তিনি মাত-মাখানো তামাক কিনতেন। হাটের এককোণে বসে এক বুড়ো চিটাগুড় দিয়ে তৈরি করতেন এই তামাকের গুলি। ওখানে দাঁড়ালে মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ নাকে আসতো। ওই বুড়ো লোকটি বেশি কথা বলতেন না। সাঁঝরাতেও বাতি জ্বালিয়ে তিনি ওই তামাক বিক্রি করতেন। বৃদ্ধ মানুষেরাই তার ক্রেতা। কেউ কেউ ওখানে বসেই কলকে সাজিয়ে টানছে আর গল্প করছে। তার পাশেই বসতেন রহিম পাইনি। তার পানেরও অনেক ক্রেতা ছিল। তিনিও সাঁঝরাত পার করেই বাড়ি ফিরতেন। এরকম ভাবতে ভাবতে আমি ভুলে যাচ্ছি বাড়ি ফেরার কথা। একদিন পাইনির ছোট মেয়ে পরী পাশের বাড়ির নবীরের সাথে পালিয়ে গেলে সে খুব কষ্ট পেয়েছিল। মা-মরা মেয়েটিকে সে অনেক আদর দিয়ে বড় করেছিল। মেয়েটিকে কারা নাকি নদীতে ভেসে যেতে দেখেছে। একথা শোনার পর রহিম পাইনি খুবই ভেঙে পড়ে এবং সে মেয়েটির শোকে কাঁদতে কাঁদতে একসময় অন্ধ হয়ে গেলে আর তার পান বিক্রির জন্য হাটে যাওয়া হয় না। পরে সে বাড়ির ভিটেতে সন্ধ্যায় বাতি জ্বালিয়ে পান নিয়ে বসে থাকতো। মানুষ তার বাড়িতে এসে পান কিনে নিয়ে যেত। রাতের এই মধ্যপ্রহরে এসে আমার মনে হলো, পরী ও নবীর কী তাহলে পাখি হয়ে গেছে। নিশি , ভুবন কিংবা পরী, নবীরের কথা ভাবতে ভাবতে আমি একটি আখখেতের কাছাকাছি এসে পড়ি। একদল জেলের সাথে দেখা হয়। তারা মাছ ধরে বাড়ি ফিরছে। আমি ওদের কাউকেই চিনি না। তারাও আমাকে চেনে না। শুধু ইশারায় ওরা জানালো ওই দূরের বাতি-জ্বলা গ্রামের দিকে যেতে। আমার মনে হলো ধীবরকন্যা সত্যবতীর কথা। ওই কালো মেয়ের মুখ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। দেখতে দেখতে জেলেরা আখখেতের ওপারে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলে অসংখ্য বাতি-জ্বলা গ্রামটি কতদূর তা আর আমি বুঝতে পারি না।

একধরনের রহস্যের মধ্যে এই অন্ধকারে আমার মন মায়াবী আলোয় উদ্ভাসিত হলো। আমি আখখেত পার হয়ে ঘন বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নতুন পাড়াটির কাছাকাছি এসে দেখলাম অজস্র প্রদীপজ্বলা নক্ষত্রপল্লী। আরো কাছাকাছি গেলে হারিকেনের আলোয় আমার মায়ের মুখটি স্পষ্ট হয়ে উঠল। বেড়াহীন একটি ঘরের মাঝখানে একটি চকি পাতা এবং আমার মা সেই চকিতে বসে আছেন বিষণ্ন মনে। আমার নিজের ভেতরে এক উদ্বাস্তু আমিকে দেখে ভেতরটা হু হু করে উঠল। গহিন ভেতরে এক ঘরছাড়া বাউলের একতারা ডুকরে উঠলে পুবদিকের আখখেতের মাথায় গম্ভীর মেজাজে চাঁদ উঠতে দেখলাম। আমাকে দেখে মা যেন নীরব হয়ে গেলেন। আমি কাছে গিয়ে মা বলে ডাক দিলে তিনি বললেন, ব্যাটা আমি তো তোমার মা নই। তিনি আমাকে চিনলেন না। বললেন, ওই যে দূরে অনেক বাতি-হারিকেনের আলো, ওই দিকে অনেক বাড়ি উঠেছে, ব্যাটা তোমার বাড়ি ওইদিকেই হবে। আমি তবু আমার ময়ের মতো বয়েসী এই মহিলার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। অতঃপর তিনি পান তৈরিতে মনোযোগ দিলে আমি দূরের আলো-জ্বলা গ্রামের দিকে যেতে থাকি।

গম্ভীর চাঁদ উজ্জ্বল হয়ে ফেটে পড়ল আকাশে। মাঠের ভেতর ফাঁকা জায়গায় গাড়া এই আস্তানা আজ ডানা মেলে আমাকে নিয়ে গেল অন্য ভুবনে। কানে ভেসে এলো- ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশেৃ’ আকাশও বেদনা জাগায়, গহিনে টান দিয়ে বলে, আয়! আমি যেতে থাকি একাকী, ঝিঁঝিঁট রাগে বহে যায় পুবালি হাওয়া, আমি সেই হাওয়ার দঙ্গলে ভেসে যাওয়া কোনো এক পাখির নাম ধরে ডাক দিই, হঠাৎ মনে হলো ‘নিশি ও ভুবনের গল্প’। মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি বুক ভরে কাঁদলাম। মনে মনে ভাবলাম, মা কি আমাকে ভুলে গেলেন, না আমিই মাকে ভুলে গেলাম। কেন যেন বার বারই মনে হচ্ছিল উনিই আমার মা। মনে হলো আবার ফিরে যায়। মনে হলো সেই সাধুর কথা, একবার বেরোলে আর ফেরা যায় না। যারা ফেরে, আসলে তারা কোথায় ফেরে, তারা নিজেরাও জানে না। আমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছি এখন, আমি বুঝতে পারি না। আমার সামনে একটিই ঠিকানা ওই আলো-জ্বলা গ্রাম, সেখানে আমার বাড়ি, নতুন ঘর উঠেছে, আর আমার মা হয়তো তাকিয়ে আছেন চাঁদের দিকে। আমার হারিয়ে যাওয়া পিতা অনেক বছর পর একদিন এরকমই চাঁদরাতে ফিরে এসেছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর মা অনেকদিন ধরে রাতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকেন আর ভাবেন, হয়তো এরকমই কোনো রাতে তিনি আবার ফিরে আসবেন- তিনি ফিরে আসবেন একটি বহুকালের পুরনো পাঞ্জাবি গায়ে, ছেঁড়া চটি পায়ে আর একটি পুরোনো সেলাই করা হাত-ব্যাগ হাতে, উসকো-খুসকো চুলে, মলিন মুখে সাদা সাদা দাঁড়ির ভেতরে জমে থাকা কষ্ট নিয়ে তিনি প্রায় পাগলের মতো দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকবেন। চুপচাপ বসে থাকবেন ভাঙা চকিটির কোণায়। অনেকক্ষণ কোনো কথা বলবেন না, অতঃপর উঠে দাঁড়াবেন এবং জানালায় চোখ গলিয়ে দেখবেন দূরের মাঠে কৃষকেরা ধান কেটে আঁটি বাঁধছে আর হেমন্তের বিকেল ক্রমশ নেতিয়ে পড়ছে বাবলাবনের ওপারে।

তখন মনের মধ্যে শুধু গান, তখন মনের মধ্যে উৎফুল্ল-হাহাকার, তখন মনের মধ্যে উদাসী হাওয়ার ক্রন্দন‘ একদিন চইলা যাইব, যাইব চইলা পুবাল হাওয়ার ডাকে / ঘর বাঁধিব ধীবর সাইজা অচিন নদীর বাঁকে / দূর দেশেতে জলের আয়নায় দেখব তোমার মুখ।’ সবাই ঘুমিয়ে গেলে আমি মাঠের মধ্যে এসে দাঁড়াই। অদূরে পদ্মার ভয়ংকর গর্জন। মনে পড়ল পুরনো ভিটের কথা, কুলু পাড়ার নিচের বাঁধ ও গোলাবাড়ির বুড়ো নিমগাছটির রহস্যময় মুখ, নিমফল ঝরে পড়ার শব্দের মধ্যে আমি হারিয়ে গেলাম। আমার জীবনবেলাকার কোনখানে যেন অবিরল ঝরে পড়ছে আমার শৈশব ‘একদিন ধানক্ষেতের আল ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে / যদি ফিরে আসি বন্ধু সেই ভাঙা ভিটাতে / দেখব তোমায় সবুজ ঘাসে নীরবে নিশ্চুপ।’ এভাবেই একটি গান এসে সেদিন ধরা দিয়েছিল সহজিয়া ঢঙে- ব্যথা ও ক্রন্দনে মোড়ানো এই গানের মধ্যে যে-জীবন ভেসে গেছে অচিন গাঙের ঢেউয়ে, সে-জীবনের কোনো গল্প হয় না, সে কেবলই একজোড়া ঘুঘু পাখির কান্নার শব্দ। আমি কি যেতে পারবো সেই বাতি-জ্বলা নতুন গ্রামে, যেখানে অপেক্ষায় আছেন আমার মা? আমি একটি খেজুর বাগানের মাঝে এসে পড়েছি। মনে হলো, ওই তো সেই বাতি-জ্বলা গ্রাম। খেজুর বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটি খালের কাছে এসে পড়েছি। মনে হলো খালটিতে বেশি পানি নেই। জলে তো নামতেই হবে। সাধু বাবা জলে ঝাঁপ দিয়ে হারিয়ে যাওয়ার আগে বলেছিলেন, ওই যে জল বয়ে যাচ্ছে, তা আর ফিরবে না। চাঁদ তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। আমি খাল পাড়ি দিয়ে যখন একটি বাবলাগাছের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালাম, ঘুঘু পাখির ডাক শুনলাম। বুঝতে অসুবিধে হলো না যে, এই বাবলা গাছেই তাদের বাসা। আমার আবার মনে হলো নিশি ও ভুবনের কথা। মনে হলো তারাও কি খুঁজে ফিরছে তাদের জন্মগ্রাম। আমি হঠাৎই অনুভব করলাম আমার পিছনে পিছনে নিশি কিংবা পরী আসছে এবং আমাকে অনুসরণ করছে। ভুবন ও নবীরও হয়তো কাছাকাছি কোথাও আছে। ভোর হয়ে আসছে। আমি সামনে তাকালাম, দেখলাম কোথাও দূরে-কাছে কোনো বাতি-জ্বলা গ্রাম নেই। আরেকটু হেঁটে একটি রাস্তায় উঠতেই সকাল হয়ে আসলো। আমি খুবই ক্লান্ত, ক্ষুধাও লেগেছে বেশ। একটি পাকুড় গাছের তলে একটি দোকান দেখলাম। দোকানি তখনো ঝাঁপ খোলেনি। কাছে গিয়ে ডাক দিলাম। কোনো সাড়া পেলাম না। দোকানের পিছনে একটি জঙ্গল। সেই জঙ্গলের পথে যেতে হবে ভেবে একটি উঁচু জায়গায় বসে ব্যাগ থেকে বিস্কিট আর পানির বোতল বের করলাম। অজস্র ঘুঘু পাখির ডাক শুনে আমি কেঁদে ফেললাম। সাধু বাবার কথা মনে হলো আবার। একবার বাড়ি থেকে বেরোলে আর যে ফেরা হবে, কে বলতে পারে। চোখে ঘুম এলে আমি মাথার তলে ব্যাগটি রেখে শুয়ে পড়ি। ভাবলাম লোকজনের চলাচল শুরু হলে ওদের আবার জিজ্ঞেস করা যাবে আমাদের নতুন বাড়ি ওরা চেনে কিনা। চোখ বুঁজলেই আমি নিশি ও ভুবনকে দেখি, দেখি পরী ও নবীরকে। দেখি নিশি, কাঠুরিয়া, সাধুবাবা কিংবা ঘুঘু পাখিদের রহস্যঘেরা জগৎ।

একটি বিষণ্ন মুখ আমাকে আজো কাঁদায়, মুখটি কার আমি জানি না; সে কি রঞ্জনা, নাকি রেহেনা, মাধবী, অপলা, নাকি নিশি কে জানে! মনে পড়ে সেই মায়াময়ী মেয়েটির কথা- জলে ডুবে যার মৃত্যু হয়েছিল আর যে জ্যোৎস্না রাতে ক্যানালের জলে ভেসে ভেসে জলদেবীর মতো জলের গোপন ঘরে লুকিয়ে পড়েছিল। আমিই কি সেই প্রেমিক যে আজো কেঁদে যাচ্ছি, যে আজো সেই জলদেবীর খোঁজে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে কাঁটার আঘাত খেয়ে, পাখিদের গান শুনে বলে উঠি- কোথায় পাবো তারে! সেই মুখের ছায়ায় আমি দেখতে পাই সুরের পানসি বেয়ে চলে যাওয়া কোনো পথিকের ছায়া, আমি সেই ছায়ার গভীরে নেমে জলরঙে এঁকে যাই গোধূলির বাণীময় রূপ। এই গল্পের মধ্যে লুকিয়ে আছে আমাদের অস্তিত্বের ক্রন্দন, ফুরিয়ে যাওয়া সেইসব বৃষ্টি ও কুয়াশার ধ্বনি।

আমার আহত আত্মার চারপাশে জ্বলে উঠছে মৃত মৃত তারাদের শহর। সেই শহরে যেন সারাক্ষণই সন্ধ্যাবেলা, যেন সারাক্ষণই অন্ধকার, একটু-আধটু আলো, সে আলোও যেন অন্ধকারের গভীর বলয়ে ডুবে যাচ্ছে ক্রমশ। কারা যেন খাঁচায় বন্দী কিছু জলচর পাখি নিয়ে বাড়ি ফিরছে- আমি দেখতে পাচ্ছি পাখিদের রক্তাক্ত হৃদয়ের তীরে ভোর হচ্ছে ধীর লয়ে, রজনীর সবগুলো দ্বার ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে রঙের কণারা- সেই দিকে মেলে ধরি আমার সযত্নে রক্ষিত গোপন পথের অর্ধনমিত মুখৃ কোথায় আমার বাড়ি- এই অমিমাংসিত প্রশ্নটি মধ্যরাতের গম্ভীর মেজাজে ঘাঁই খেতে খেতে ফিরে আসে শেষে জননীর অবলা আঁচলের গুল্ম-লতার ত্রিকোণ চাতালেৃ আমি অনুভব করি একটি ডুবোচর আমার স্নায়ুতন্ত্রের নিচে ঘুমিয়ে আছে বহুকাল। বহুকাল আমার চোখে কোনো ঘুম নেই। আমার দীর্ঘ একটি ঘুমের দরকার- একটি ঘুম যার তলদেশের জংলা নদীতে একটি ২০০ বছরের কচ্ছপ ধীরে ধীরে এগোচ্ছে কোনো শারদীয় আকাশের খোঁজে- নিশিকাকের স্বপ্ন নিয়ে হু হু করে চলে যাচ্ছে বাতাস- এক বুড়ো গজাড়ের অলস ঘুমের কর্দমাক্ত সরণীজুড়ে বেজে উঠছে অলোকসামান্য বেহালা- ।

আমার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। সাধুবাবার কথা মনে হতেই একপশলা বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে গেল হৃদয়পুরের নিঃশব্দ বনভূমি। বাতি-জ্বলা গ্রাম কতদূর কে জানে। আমার ক্লান্ত দেহে নেমে আসছে একরাজ্যের ঘুম। আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে যাবার আগে স্বপ্ন ও জাগরণের অন্ধকার কুয়াশার ভেতর তাকালাম- দেখি, একটি শৈশব হারানো নদী, বুকে তার অজস্র পাথর, সূর্যের প্রখর উত্তাপে সেই পাথর গলে গলে তৈরি হচ্ছে কথা ও কবিতা, আর এই পাথর-নদীতে ডুবে-মরা শত শত মানব-মানবীর ভাসমান আত্মার গ্রাম থেকে নেমে আসছে এক রহস্য-রাখালের চোখ-নিসৃত সহজিয়া সুর। কোনো পাহাড়ি ঝরনার ওপর দিয়ে সেই সুর ঈশ্বরের নৈঃশব্দ্যসহ ভেসে আসছে যেন। আমি সেই সংগীতের নিবিড়তা ছুঁয়ে হেঁটে যাচ্ছি অজস্র ঘুঘু পাখির সকরুণ কান্নার ভেতর…….

লেখাটি প্রতিকথা’র কবিদের গল্প আয়োজন থেকে নেওয়া।