মোজাম্মেল হক/
লোকসানী ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠান লালপুর উপজেলার গোপালপুরে স্থাপিত নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল। এই মিলে শিল্পপার্ক গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা ছিল তাও ভেস্তে যেতে বসেছে। শিল্পপার্ক গড়ার প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১৪ সালে। কো-জেনারেশন পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সুগার রিফাইনারি (চিনি শোধনাগার) স্থাপন প্রকল্পে একনেকে অর্থ বরাদ্দের পর নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু করতে না পারায় সম্প্রতি প্রকল্পটি বাতিল হয়ে গেছে। প্রকল্পটি ৭৩ কোটি টাকা খরচে দুই বছরের মধ্যেই অর্থাৎ ২০১৬ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। ফলে লোকসান কাটিয়ে উঠতে না পারলে এই মিলের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিৎ। ইতোমধ্যে দেশের ১৫ টি চিনিকলের ৬ টি চিনিকল বন্ধ হয়ে গেছে। চিনিকলগুলো বন্ধের প্রধান কারণ লোকসান। বছরের পর বছর লোকসান গুনতে গুনতে শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে সরকার।বন্ধ চিনিকলগুলো আধুনিকায়ন করার কথা বলা হয়েছে। শুধু তাই নয় বন্ধ চিনিকলের কাউকে চাকুরি হারাতে হবে না এমন প্রতিশ্রুতিও সরকারের। ফলে চিনিকল চালু রাখার পক্ষে উল্লেখযোগ্য আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। কারণ কর্ম হারানোর ভয় পেয়ে বসেনি কাউকে।
বাস্তবতা হলো, বন্ধ হয়ে যাওয়া চিনিকলের স্থায়ী শ্রমিকরা কাজ না হারালেও চুক্তিভিত্তিক, দৈনিক হাজিরার শ্রমিক-কর্মচারীদের দায় কিন্তু সরকার নেয় নি। স্থায়ী চাকুরির আশায় দীর্ঘ দিন কাজ করা ওইসব শ্রমিক-কর্মচারীরা আজ বেকার। অথচ চুক্তি ভিত্তিক চাকুরি পেতেই তাদের অধিকাংশকেই কোন না কোন ভাবে নিয়োগ বাণিজ্যের শিকার হতে হয়েছিল। ঠিক তেমনি নিয়োগ বাণিজ্যের শিকার হয়ে চুক্তিভিত্তিক অথবা দৈনিক হজিরায় কাজ পাওয়া বর্তমানে চালু থাকা চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীরা সমন্বয়ের সিদ্ধান্তে বেকার হতে বসেছে। অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি ছিল ঘরে ঘরে চাকুরি দেবার। তিনি হয়তো জানেনই না চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীরা সমন্বয়ের মারপ্যাঁচে পড়ে ছাঁটাই এর শিকার হতে চলেছেন।
লোকসানী চিনিকল বন্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় কোন শ্রমিক-কর্মচারী যেন ছাঁটায়ের শিকার না হন, সে বিষয়টিই আগে ভাবা হয়েছে। আর সে কারণেই চালু থাকা চিনিকলের শুন্যপদে বন্ধ হয়ে যাওয়া চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীদের সমন্বয় করে চাকুরি বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শুন্যপদ গুলোতে যে চুক্তিভিত্তিক লোক নিয়োগ দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। তারা যে কর্ম হারাবেন, সে বিষয়টি হয়তো আলোচনাতেই আনা হয়নি।
নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল চালু থাকায় বন্ধ চিনিকলের স্থায়ী শ্রমিকদের বদলি করে সরকারের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হচ্ছে। আর সে কারণেই নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের চুক্তিভিত্তিক ৩ শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী কর্ম হারাতে বসেছেন। এদের মধ্যে এক বছর থেকে ১০/১২ বছর ধরে কাজ করছেন এমন শ্রমিক-কর্মচারীও রয়েছেন।
এই তো গত বছর মিল চলাকালিন সময়ে যারা প্রতিদিন মাত্র ২৬০/- টাকায় ‘কাজ নেই, নেই মুজুরি নেই’ চুক্তিতে মিলের বিভিন্ন সেক্টরে কাজ নিয়েছেন, তাদের কি অপরাধ? একটি বছর পার হতে না হতেই বিদায় নিতে হবে? একটা স্থায়ী কর্মসংস্থানের স্বপ্ন তো মানুষ দেখতেই পারে তারা।
শ্রমিক-কর্মচারী ছাঁটাই এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ-সমাবেশ হচ্ছে। এ ধরণের আন্দোলন সাধারণত: সফল হয়না। কারণ নেতারা শেষ পর্যন্ত সাথে থাকেন না। থাকতে পারেন না।
সমাবেশের নেতৃবৃন্দ বলেছেন, নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে কর্মরত চুক্তি ভিত্তিক শ্রমিক-কর্মচারীকে প্রতিমাসে যে টাকা দিতে হয়। অন্য চিনিকল থেকে বদলি হয়ে আসা সমপরিমান শ্রমিক কর্মচারীদের প্রতিমাসের বেতন দিতে হবে তার দিগুনেরও বেশী। গত আখ মাড়াই মৌসুমে বন্ধ হয়ে যাওয়া পার্শ্ববর্তি চিনিকল এলাকার আখ পরিবহণ খরচ আর চিনি আহরনের হার কমের কারণে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে চিনি উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। ফলে লোকসান অন্য বছরের তুলনায় বেড়েছে। অন্য মিল এলাকার আখ আর শ্রমিক-কর্মচারী দুটো’ই নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের জন্য এখন গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত। চালু থাকা সবগুলো চিনিকলের একই অবস্থা বিরাজ করছে।
নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের কৃষি খামারগুলো আখচাষ করে প্রায় প্রতিবছরই লোকসান দিয়েছে। আর এ থেকে পরিত্রাণ পেতে শেষ পর্যন্ত কৃষি খামারের জমি লীজ দিয়ে দায় সেরেছে কর্তৃপক্ষ। কৃষক মিলের জমি নিয়ে আখ বা অন্য ফসল আবাদ করে লোকসান গুনবেন না নিশ্চয়। কারণ আখচাষ থেকে কি করে অর্থ উপার্জন করতে হয় তা তারা জানেন। তাহলে খামার ব্যবস্থাপনায় যারা থেকেছেন, তারা কেন বুঝতে পারলেন না খামারে লোকসানের মূল কারণ। খামার কর্তৃপক্ষ এবার বাড়তি শ্রমিক ছাঁটায়ের কথা ভাবছেন। খামারের জমি লীজ আর শ্রমিক ছাঁটাই কি কোন দীর্ঘস্থায়ী সমাধান বয়ে আনতে পারবে?
বিগত কয়েক বছর ধরে আমরা লক্ষ্য করছি লালপুর উপজেলায় আখচাষ কমছে, বাড়ছে তামাকের মত ক্ষতিকর ফসলের আবাদ। যার অন্যতম কারণ তামাক কোম্পানী গুলোর অপতৎপরতা। তারা কৃষকদেরকে দীর্ঘ মেয়াদি ফসল আখের বিকল্প হিসেবে তামাক আবাদের সুবিধা সম্পর্কে বুঝিয়ে সফল হয়েছে। এছাড়া শষ্য বহুমুখিতার কারণেও আখের আবাদ দিন দিন কমছে। আখচাষের জন্য ঠিক এমনি এক সংকটময় মুহুর্তে গতবছর আখচাষ মৌসুমে সময় মত কৃষিঋণ পেলেন না কৃষক, সময়মত মেলেনি আখচাষে ব্যবহৃত রাসায়নিক সারও। ফলে অর্থ সংকটে আখচাষ করতে পারেননি অনেক কৃষক।
অধিকাংশ সুগার মিলে ব্যবহৃত মান্ধাতা আমলের যন্ত্রপাতি যা কিনা আজকাল খুজে পাওয়াও মুশকিল। আখমাড়াই মৌসুম শেষ হওয়ার পর কারখানা ওভার হোলিং চলাকালে সময়মত যন্ত্রাংশ না পাওয়াটা ব্যায় বাড়ায়। এক সময় কারখানা শ্রমিকদের হাতে তেমন কাজ থাকে না। ঠিক মাড়াই মৌসুম শুরুর আগে শ্রমিকদের ওভার টাইম দিয়েও কাজ ওঠানো নিয়ে সংশয় থাকে। নানা কৌশল অবলম্বন করতে হয়। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে কারখানাকে অবশ্যই আধুনিকায়ন করতে হবে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে চিনিকলগুলোর জন্য মোট ৩ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন। এর মধ্যে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরেই লোকসান ছিল ৯৭০ কোটি টাকা। চিনিকলগুলোর বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগও পুরোনো। সে জন্য এসব প্রতিষ্ঠানে কী হচ্ছে, তা দেখতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের ১৫ কর্মকর্তাকে নিয়ে সম্প্রতি একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। চিনিকলগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত করা, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি ও অব্যাহত লোকসান কমানোর উদ্দেশ্যে এই কমিটি গঠন করা হয় বলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক অফিস আদেশে জানানো হয়েছে।
এদিকে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘দেশের সুগার মিলগুলো অনেক পুরনো। চিনি উৎপাদন প্রযুক্তিও আধুনিক নয়। অন্যদিকে মাঠে আখের উৎপাদনশীলতা কম। এতে চিনি উৎপাদনে খরচ অনেক বেশি হয়। বর্তমানে ১ কেজি চিনি উৎপাদন করতে যে খরচ পড়ে তা কমিয়ে আনা যায় কি না, যাচাই করা দরকার। প্রয়োজনে ‘আধুনিক প্রযুক্তির ১টি মডেল সুগারমিল’ পরীক্ষামূলকভাবে স্থাপন করা যেতে পারে। এর সাথে মাঠে উন্নত জাতের আখের চাষ। তারপরও যদি দেখা যায়, চিনির উৎপাদন খরচ কমছে না। আখ চাষ লাভজনক না হলে দেশে চিনিকল বন্ধ করে দেওয়া দরকার।’
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান স্বর্গীয় রনজিৎ কুমার বিশ্বাস নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের শ্রমিকদের উদ্যেশ্যে বলেছিলেন, ‘চিনিশিল্প একদিন জাদুঘরে চলে যাবে, আমরা বনের পাখিরা বনে চলে যাবো। আপনারা ঘরের পাখিরা চেষ্টা করে দেখেন এটাকে ধরে রাখা যায় কিনা?’ তার এই কথাটা সত্য হতে চলেছে। তিনি তার জায়গা থেকে হয়তো বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাই চিনিশিল্প নিয়ে এমন মন্তব্য করেছিলেন।
আখচাষে নিরৎসাহিত করা বা পুর্ণাঙ্গ সহযোগীতা থেকে বিরত থাকা সহ দায়িত্বশীলদের নেতিবাচক যে কোন মন্তব্য শুভলক্ষন নয়। এব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন ও আন্তরিক হতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলো যেন ব্রেকইভেন্ট পয়েন্টে গিয়ে দাঁড়াতে পারে সেই চেষ্টা টুকু করতেই হবে। এটা সত্য যে, চিনিশিল্প রক্ষার দায় শুধু শ্রমিক-কর্মচারীদের নয়। সকলের সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, আন্তরিকতা আর সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতাই পারে এ শিল্পের প্রাণ ফেরাতে।
বাজারে চিনির মূল্য স্থিতিশীল রাখতে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় দেশীয় চিনিকলে উৎপাদিত চিনি। চিনিকলগুলো বন্ধ হলে সিন্ডিকেটের কবলে বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে চিনির বাজার। জাতীয় স্বার্থেই চিনিকলগুলো টিকিয়ে রাখা দরকার। চিনি শিল্পকে বাঁচতেই হবে, দাবি সকলের।
(পদ্মাপ্রবাহ এর সম্পাদকীয় পাতায় ছাপা লেখা।)