আনছার আলী দুলাল/
আলহাজ¦ মোঃ সামসুল হক প্রামাণিক ছিলেন আত্মমর্যাদা ও ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন সৎ মানুষ। যেখানে যে অনুষ্ঠানেই যেতেন সেখানেই তার উপস্থিতি অঘোষিতভাবে অভিবাকত্ত্ব প্রকাশ পেত। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত সমাজপতি, মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক, বঙ্গবন্ধু প্রেমিক ও দেশপ্রেমিক। তিনি ছিলেন সদালাপি। সকলকে ভালোবাসতেন, ধনী গরিব ও ছোট-বড় তার অসংখ্য বন্ধু ছিলো। কেউ বিপদে পড়লে তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করা ছিল তার জরুরী কাজ।
তিনি ১৯৪১ সালের ২৬ মার্চ বুধবার ততকালীন রাজশাহী জেলা বর্তমানে নাটোর জেলার লালপুর থানার বরমহাটী গ্রামে পিত্রালয়ে মধ্যবৃত্ত পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। পিতার নাম মোঃ ঈমান উদ্দীন প্রামাণিক ও মাতার নাম মোছাঃ সবুরজান বিবি। তার দাদার নাম মোঃ আব্দুর জব্বার ওরফে ফেঙ্গন প্রামাণিক, দাদীর নাম পিঞ্জিরা অভিরন। তার নানার নাম মোঃ গগন কাজী ও নানীর নাম মোছাঃ জামিরণ নেছা কাজী ওরফে জমিরজান। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ না করলেও প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ ছাত্র হিসেবে নিজেকে পরিচিত করেছেন তিনি। বাড়ীতে শিক্ষক রেখে লেখা পড়া করেছেন। ছোট বেলা থেকে তিনি কৃষি কাজে পিতা ও বড় ভাইকে সহযোগীতা করতেন। বড় ভাই মোঃ ছবির উদ্দিন প্রামাণিক ১৯৬৭ সালে অসুস্থতায় মৃত্যুবরণ করলে তাকে সংসারের ভার গ্রহন করতে হয়। ১৯৬৯ সালে লালপুর থানার সাদিপুর গ্রামের মোঃ নবীর উদ্দিন প্রামাণিক ও মোছাঃ হারেজান বিবির বড় মেয়ে মোছাঃ সাহারা খাতুনের সাথে বিয়ে হয়। ১৯৭২ সালে তাদের একমাত্র পুত্র সন্তান জন্মগ্রহন করে। মাত্র ৮ মাস বয়সে মহামারী বসন্ত রোগে তার মৃত্যু হয়।
তিনি ছোট বেলা থেকে কাচারী শালিশ দরবার ও সামাজিক বিচার ব্যবস্থায় অংশ নিতেন এবং পারদর্শী ছিলেন। গ্রাম থেকে ইউনিয়ন, থানা ও নিজ জেলার বাইরেও শালসী বিচার কার্যে যেতেন। তিনি অত্যাধিক মিশুক, অদম্য প্রখ্যাত শালসী, সঠিক বক্তা, ন্যায় বিচারক সত্যবাদী আদর্শ মানুষ ছিলেন। সহজেই মানুষকে আকুষ্ট করার শক্তি ছিল তার। তার কন্ঠ ছিল অনেক প্রসার ও ভরাট। তিনি তিক্ষè ও স্বচ্ছ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। ছোট বেলায় তিনি উচ্চস্বরে অনেক গান গাইতেন। তার স্বরণ শক্তি ছিলো প্রখর। রেডিওতে যে কোন গান একবার শুনেই হুবহু গাইতে পারতেন। বহু লোকের নাম জানতেন। ছেলের নাম, বাবার নাম, দাদার নাম, নানার নাম, কোথায় থাকে অবস্থান সহ অনেকের নাম মনে রাখতে পারতেন।
তিনি দানবীর ছিলেন। বংশপরমপরাই তার বাড়িতে প্রায় প্রতিদিনই অতিথী ও মুসাফিররা বৈঠক খানা ঘরে পরবাস থাকতেন। তিনি মসজিদে জমিদান সহ বিভিন্ন মসজিদে ও মাদ্রাসায় নগদ টাকা ও আসবাবপত্র দান করেছেন। তিনি প্রচুর ইসলামিক জালসা শুনেছেন। তিনি ছোট বেলা থেকেই রোজা করতেন ও নামাজ পড়তেন। তার জীবদ্দশায় হাজারের ওপরে মানুষের জানাযায় অংশ নিয়েছেন। মৃত ব্যাক্তির পরিবারের পার্শ্বে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সান্তনা দেওয়া। সে যে ধর্মেরই মানুষ হোকনা কেন?
অপরদিকে তিনি অনেক যাত্রাপালাও দেখেছেন। তিনি বলতেন “যাত্রা পালা থেকে আমি অনেক বাস্তব জ্ঞান লাভ করেছি”।
তিনি ১৯৬৮ সালে আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে লালপুর থানা আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম মোরহুম আঃ ছাত্তার চৌধূরীর সহযোগীতায় থানা আহব্বায়ক কমিটির সদস্য মনোনীত হন। তিনি দলের প্রতিটি মিটিং এ উপস্থিত হতেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৯নং গোপালপুর ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন এবং ১৯৮০ দশকে আওয়ামী লীগের ক্লান্তি লগ্নে শহীদ মমতাজ উদ্দীন এর মৌখিক নির্দেশে লালপুর থানা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দ্বায়িত্ব পালন করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারী জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে যখন ঈশ্বরদী রেলওয়ে স্টেশনের ওভার ব্রীজের নীচে রিক্সা স্ট্যান্ডে সমাবেশে আসেন। মিটিং শেষে ঈশ্বরদীর এক লম্বা দেহী বয়স্ক বিহারী শেখ মুজিবুর রহমানকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন “ওই ছোকরা তুমতো পূর্ব পাকিস্থানকে হিন্দুস্থান বানাবা” বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান উত্তরে বলেছিলেন আমি মুসলিম সন্তান আমি মুসলমান। সামসুল হক সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের হাতে হাত রেখে হ্যান্ডসেক করেন।
৬৯ এর গণ অভ্যুথানের তার অংশগ্রহন ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান অনেক। মুক্তিযোদ্ধাদের যাতায়াত ছিলো অনেক কঠিন তাই চিনা জানা রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন রাতেই প্রায় অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের পারাপার করতে হতো শান্তি বাহিনী ও পিচ কমিটির নজর এড়িয়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের রাখা খাওয়ানো, আশ্রয়দেয়া এ সকল কাজ তিনি করতেন। ছোট ভাই আনছার আলী দুলাল ও মাঝে মধ্যে তাদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করতেন। একরাতে পাল্লাডাঙ্গা নদী পার হতে গিয়ে বাশের আড় ভেঙ্গে প্রায় ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ও সামসুল হক অস্ত্র সহ ভরা নদীতে পড়ে যান এবং অনেক কষ্টে সাঁতরিয়ে পাড়ে উঠেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকলীন তিনি দুইবার রাজাকাদের হাতে গ্রেফতার হন এবং সুকৌশলে বেঁচে যান।
১৯৭১ সালে ৫মে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে পাকিস্থান বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন এবং শহীদ সাগরে যাওয়ার পূর্বেই তিনি নিজেকে আড়াল করে জীবন রক্ষা করেন। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ কালোরাতের পর ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ গোপালপুর রেলগেট পাকিস্থানী বাহিনীর প্রতিরোধ কালীন সময়ে তিনি উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে ময়না, সিংহ (বিজয়পুর) বামন গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধ শুরু হলে সামসুল হক স্থানীয় ই.পি.আর দের সাথে নিয়ে সরাসরি যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন। রাত ভর যুদ্ধের পর পাকিস্থান বাহিনী পরাজিত হবার পরের দিন সকালে সামসুল হক ছোট ভাই আনছার আলী দুলাল সহ কয়েক জনকে সঙ্গে নিয়ে ময়না গ্রামের যুদ্ধ বিধস্থ স্থানে উপস্থিত হন। তার উপস্থিতিতেই একজন পাকিস্থানি তরুণ সৈনিককে ই.পি.আর যোদ্ধা গুলি করে হত্যা করে‘।
সামসুল হক ১৯৮৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৯নং গোপালপুর ইউনিয়নের বৃহত্তর ৩নং ওয়ার্ডে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সদস্য (মেম্বর) নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারীর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তিনি গোপালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দীতা করেন।
তিনি বরমহাটী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বরমহাটী সমবায় উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন। শালেশ্বর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শালেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয় এর বিদ্যুৎসাহী সদস্য হন পরে ম্যানেজিং কমিটির সহ সভাপতি নির্বাচিত হন। গোপালপুর ডিগ্রী কলেজ, গোপালপুর উচ্চবিদ্যালয়, গোপালপুর জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা ছিল। তিনি বরমহাটী ফুরকানিয়া মাদ্রাসার একাধিক বার সেক্রটারি এবং বরমহাটী ঈদগাহ কমিটির সভাপতি ছিলেন। বরমহাটী কমিউনিটি ক্লিনিক এর প্রতিষ্ঠাতা সহ সভাপতি ছিলেন।
কৃষি উন্নয়নে সর্বপ্রথম কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গঠিত মাঠ রক্ষা কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। সম্রাজ্যবাদ বিরোধী ইরাক আক্রোমনের বিরোধে লালপুর নাগরিক কমিটির সদস্য ছিলেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে উত্তরবঙ্গ চিনিকল আখচাষী সমিতির উদ্দোগতাদের অন্যতম একজন হিসেবে ভূমিকা রাখেন। উত্তর বঙ্গ চিনিকল আখচাষী সমিতির প্রথম কার্যকরী কমিটির সদস্য পরে সহসভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ আখচাষী ইউনিয়ন জাতীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৯৭ সালে মিল কর্তৃপক্ষের মামলায় তিনি গ্রেফতার হন এবং পরেরদিন লালপুর থানা থেকে মুক্তিপান।
এছাড়া তিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত কমিউনিষ্ট নেতা কমরেড দেবেন সীকদার জাতীয় স্মৃতি পরিষদের প্রতিষ্ঠতা সদস্য ছিলেন। জাতীয় কৃষক সমিতির লালপুর থানা কমিটির সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ বিপ্লবী কৃষক সংহতি নাটোর জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী সার্বজনীন উদযাপন জাতীয় কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন।
তিনি ভ্রমণ পিপাসু মানুষ ছিলেন। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলার দর্শনীয় স্থান তিনি ভ্রমন করেছেন। ২০১২ সালে তার সহধর্মীনী সাহারা বেগমের মৃত্যুর পর তিনি ছোট ভাই আনছার আলী দুলালের সাথে থাকতেন। ২০১৮ সালে তিনি হজ্জ্ব পালন করেন।
২০২১ খ্রিঃ ৫ জুন রাতে আলহাজ্জ্ব সামসুল হক ব্র্রেইন স্টোক করলে তাকে প্রথমে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর হাসপাতালে পরে ন্যাশনাল ইনইসটিটিউট অব নিউরো সাইন্সেস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯/০৬/২০২১ ইং তারিখ শনিবার সকাল ৯.১৫ মিনিটে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। পরদিন ২০/০৬/২০২১ রবিবার বেলা ১০ ঘটিকায় জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে চির নিদ্রায় শায়িত হন। এর মধ্যদিয়ে বৃটিশ, পাকিস্থান ও বাংলাদেশ তিন রাষ্ট্রের বাসিন্দা সামসুল হক যুগ ও তার জীবনের সমাপ্তি ঘটে।