ড. কাজল রশীদ শাহীন
ঈদ আসছে। দুই সপ্তাহ সময়ও বাকি নেই, তার আগেই হবে হাজির। মানুষের মন ভালো থাকুক আর না থাকুক- ঈদ আসবে যথানিয়মে-ঠিকসময়ে। ঈদের আনন্দ কিংবা ঈদ উৎসব পালন করার সামর্থ্য ও মানসিক স্বস্তি-বাস্তবতা জেনে ঈদ আগেও আসেনি- এবারও আসবে না। ঈদ আসবে- সব সময়ই আসে দিনপঞ্জির নিয়মে-সময়ের চাকায়। করোনার দিনগুলোতে এ দেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছে ঈদ প্রতীক্ষিত নয়, যদিও হওয়ার কথা ছিল তেমনটাই- যুগ যুগ ধরে হয়েও আসছে ঠিক এ রকমই।
করোনাকালের ঈদ হওয়া উচিত ছিল বহুল প্রতীক্ষিত। মানুষের মাঝে এই ভাবনা জোরদার হওয়া প্রয়োজনীয় ছিল যে, অন্তত ঈদের আগে-পরের কয়েকটা দিন আনন্দ-খুশির আবহে মেতে থাকতে পারবে। নিজের দুঃখ-কষ্ট-হতাশা-ব্যথা-বেদনাকে আড়ালে রাখার-ভুলে থাকার একটা সুযোগ পাবে। নিজের নেই তো কী হয়েছে, অন্যের তো আছে- তাদের আনন্দ-হাসিও যখন প্রকাশিত হবে অসহায়-সম্বলহীনদের ঘিরে- তখন তারাও মেতে উঠবে ঈদ আনন্দে।
ধর্মের শিক্ষাও এটা, যার নেই তাকে দাও। যার আছে সেখানটাই সবার হক বা অধিকার আছে। কিন্তু সেই শিক্ষা তো জারি নেই বাঙালি মুসলমান সমাজে। এ কারণে করোনার দিনগুলোতে ঈদের আগমন মানে এ দেশের বেশিরভাগ মানুষের দুঃখ-কষ্ট-ব্যথা- বেদনা-হতাশা-অপ্রাপ্তিকে আরও বাড়িয়ে দেওয়া। ঈদের আগমন মানে অভাবী-সমস্যা জর্জরিত অভিভাবকদের শূন্যতাকে আরও উদোম করে ফেলা। ঈদের আগমন মানে সন্তানের দাবি মেটাতে না পেরে বাবার নীরব কান্না, যা শোনারও কেউ নেই, দেখারও কেউ নেই।
করোনার দিনগুলো প্রলম্বিত হচ্ছে কেবলই। সেই যে ২০১৯-এর একেবারে শেষাশেষি চীনের উহান প্রদেশে দেখা দিল, তার পর যাওয়ার কোনো নামগন্ধ তো নেই- উল্টো ধরন বা ভ্যারিয়েন্ট পরিবর্তন করে বিশ্বকে তোলপাড় করে চলেছে এবং এক-এক সময় এক-এক অঞ্চলকে দাপিয়ে পর্যুদস্ত করছে। দাপাদাপির চূড়ান্ত রূপ এখন সংঘটিত হচ্ছে এ দেশে। ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের আক্রমণে মৃত ও শনাক্তের সংখ্যা ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী। বুধবার ছিল দেশে এযাবৎকালে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সর্বোচ্চ রেকর্ড। সংখ্যা ছিল ২০১ জন। উল্লেখ্য, দেশে ২০২০ সালের মার্চে প্রথম করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়। আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা সর্বমোট ১৫ হাজার ৫৯৩ জন। মৃত্যুহার ১.৬০ শতাংশ। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৯ লাখ ৭৭ হাজার ৫৬৮ জন। করোনা ভাইরাসের বর্তমান ঢেউ শুরু হওয়ার পর প্রতিদিনই মৃত্যুর হার ও রোগী শনাক্তের রেকর্ড তৈরি হচ্ছে।
করোনার বর্তমান ঢেউকে আমলে নিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক লকডাউন দেওয়া হয়েছে। প্রথমে এক সপ্তাহের জন্য দেওয়া হলেও তা বাড়ানো হয় আরও সাত দিন। মোট ১৪ দিনের এই লকডাউন শেষ হবে ১৪ জুলাই। লকডাউনকে ঘিরেও বিস্তার ঘটেছে অজস্র প্রশ্নের। জীবন না জীবিকা- এই প্রশ্নও এসেছে আলোচনায়-বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। কিন্তু এসব প্রশ্ন যে বিতর্কের কোনো বিষয় নয়, তা বুঝতে চাইনি অনেকেই। অজস্র কথা বলার সুযোগ রয়েছে পক্ষে-বিপক্ষে। কিন্তু সময়টা পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলার নয়, সময়টা এখন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর, হাতে হাত রাখার, কান্নাগুলো মুছে দিয়ে যতটা সম্ভব ততটা হাসি ফোটানোর। তাই তর্ক কিংবা যুক্তি শিকেয় তুলে রাখুন, বিপদাপন্নকে বিপদমুক্ত করুন, মানুষের ধর্ম পালন করুন।
করোনার দিনগুলোতে ঈদের আগমন ঘটছে চতুর্থবারের মতো। ২০২০-এ গেছে দুটো ঈদ। ২০২১-এর দ্বিতীয় ঈদ এই ঈদুল আজহা। গত বছরের ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা ছিল করোনা দেখা দেওয়ার একেবারে শুরুর দিকে। মানুষ কষ্ট করে, নিজের পুঁজি ভাঙিয়ে, ধারদেনা করে যতটা না হলেই নয়, তাই দিয়ে কোনোরকমে পার করেছে দু-দুটো ঈদ। আশায় বুক বেঁধেছে এ বছরের ঈদটা ঈদের মতো করেই পালন করবে। ঈদুল ফিতরে সেই আশা পূরণ হয়নি। বুকভরা হাহাকার নিয়ে ভেবেছে ঈদুল আজহাটা অন্তত ঠিকঠাকমতো করবে। ছেলে-মেয়ে-ভাই-বোন নিয়ে ঈদ উৎসবটা ধরতে না পারলেও ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করবে। কিন্তু সে আশার গুড়েও পড়ল বালি। পরিস্থিতি হলো আরও খারাপ। করোনায় মৃত ও সংক্রমিত হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে কেবলই। লকডাউন-শাটডাউনে রূপান্তরিত হয়েছে। এই অবস্থায় ঈদের আগমন তাদের জন্য কতটা কষ্টকর, তা কি ভেবে দেখা হচ্ছে কিংবা সমাজ-রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠান সেটা ভেবে দেখার কোনো গরজ বা তাগিদ বোধ করছে? ধর্মের শিক্ষা-মানবিকতার শিক্ষা যাই-ই বলি না কেন, কেউ কি এড়াতে পারেন এই দায়? সমাজ-রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠানেরও কি কোনো প্রকার ভাবান্তর আছে ওই সব মানুষের এই করোনার দিনগুলোতে ঈদ কীভাবে হবে- কেমনে হবে সেসব নিয়ে? ঈদের আনন্দহীন মানুষের ঈদ আনন্দ কীরূপে পূরণ করা সম্ভব সেটা ভাবা ও বাস্তবায়ন করা তো রাষ্ট্র-সমাজ প্রতিষ্ঠানের কাজ, ধর্মের শিক্ষা, মানবিকতার মৌল সৌন্দর্য।
যিনি সরকারি-আধা সরকারি চাকরিজীবী, যিনি ধনীর দুলাল- পৈতৃকভাবে ধনসম্পদের অধিকারী- যিনি যে কোনো প্রকারেই অঢেল ও ঢেল সম্পত্তির মালিক বনে গেছেন- যিনি করোনাকালেও চাকরি করছেন এবং নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন- করোনা কোভিডের আঘাতেও যার স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহ হোঁচট খেয়েও চলছে কোনোরকমে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হলেও চালিয়ে নিচ্ছেন- সেসব স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারী যাদের আর যাই-ই হোক মাস শেষে বেতনের টাকাটা পেতে কোনো প্রকার কসুর করা লাগছে না- আমি তাদের কথা বলছি না। তারা ভালো আছেন, ভালো থাকুন। কিন্তু অন্যরা যে ভালো নেই সেটা ভেবে দেখেছেন কি? আচ্ছা পুরো করোনাকালে না হয় ভাবলেন না, অন্তত এবারের ঈদটা সামনে করে ভাবুন। বোঝার চেষ্টা করুন এই করোনাকাল ও তিন-তিনটা ঈদ পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনো প্রকার আয়-উপার্জন ব্যতিরেকে তারা কীভাবে পালন করেছেন?
আসুন, একটাবারের জন্য হলেও চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করি, উপার্জন সচল থাকা ওইসব মানুষের বাইরে এ দেশের যে একটা বিরাটসংখ্যক মানুষ রয়েছে যাদের জীবনের চাকা চলছে না কোনো প্রকারেই তাদের কথা। এই করোনাকালে তাদের ঈদ কেমন হবে একবারও কি ভেবে দেখার অবকাশ হবে আপনাদের? ওই মানুষটার কথা কি ভাবছি আমরা- যিনি করোনা দেখা দেওয়ামাত্রই চাকরি হারিয়েছেন, চাকরি থাকলেও বেতন নেই। ওই মানুষটার কথা কি ভাবা হচ্ছে যারা গাড়ির চাকা ঘুরলেই কেবল কটা টাকা পেতেন দিনের শেষে। ওই স্কুল-কলেজ-শিক্ষকের কথা কি ভাবার ফুরসত আছে কারোর, যার স্কুল বন্ধ তো বেতন বন্ধ।
পিপিআরসি ও ব্র্যাকের সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, করোনায় দেশে ২ কোটি ২৫ লাখ নতুন দরিদ্র হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৫২ শতাংশেরও বেশি। বিপুলসংখ্যক এই দরিদ্র মানুষ করোনার দিনগুলোতে কেমন আছে তা জানার প্রয়োজন বোধ করেছি কি কেউ? সেটা করা হয়নি বলেই স্বাভাবিক নিয়মেই বেড়েছে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা। ফলে করোনা গুটিকয়েক মানুষকে ছাড়া দরিদ্রকে আরও দরিদ্র করেছে। এই অবস্থায় কীভাবে-কেমনে ঈদ উৎসবে শামিল হবে বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষ, এই প্রশ্ন জারি থাকলেও উত্তর দেওয়া যাদের দায়িত্ব তারা চুপচাপ থাকতেই পছন্দ করেন বেশি।
যার পা আছে, তার পক্ষে পা না থাকা একজন মানুষের কষ্ট উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। অথচ তিনিই সত্যিকারের পূর্ণাঙ্গ মানুষ- যিনি সেটা উপলব্ধি করেন। এই ঈদে আসুন আমরা সেই পূর্ণাঙ্গ মানুষের পরিচয় দিই। যার কোনো প্রকার আয়-রোজগার নেই- একটা দিনের জন্য হলেও তার পাশে দাঁড়াই, তার জন্য বরাদ্দ রাখি ততটা- যতটা সম্ভব এবং এটাকে করুণা বা অনুগ্রহ না ভেবে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যজ্ঞান করি।
লকডাউন বা শাটডাউন চলছে দেশজুড়ে, নিয়মভঙ্গের দায়ে আটক ও জরিমানাও করা হচ্ছে দেদার। প্রশ্ন হলো, যারা নিয়ম ভেঙেছে সবাই-ই কি শখের কারণে নাকি পেটেরও দায় ছিল। একটা প্রবাদ আছে, শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে। চিরন্তন এই প্রবাদ বাক্যের পুরোটা দেখার প্রত্যাশা আমাদের, অর্ধাংশ নয়। এই লকডাউনে মানুষকে খালি ঘরবন্দি আর দণ্ড দেওয়াই কি আপনাদের উদ্দেশ্য, নাকি মানুষের পাশে দাঁড়ানোটাই প্রধানতম কাজ। কিন্তু সেটা কেন করা হচ্ছে না, তার উত্তর জানা নেই কারও।
করোনাকালের ঈদও হোক ঈদের মতো এবং সেটা সম্ভব হবে কেবল সামর্থ্যবানরা যদি অপরের দুঃখ-বেদনাটা কিঞ্চিত হলেও বোঝার চেষ্টা করেন। সামর্থ্যবানরা প্রতি ঈদেই গরিব-দুঃখীদের জন্য কিছু না কিছু করেন। এবার যদি তারা মনে করেন, প্রতিবারই তো করা হয়, এবার না হয় থাক। তা হলে সেটা অসহায়দের জন্য অধিকতর বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। বরং ছোট-বড়-মাঝারি সব ধরনের সামর্থ্যবানদের ভাবা উচিত প্রতিবারের মতো নয়, এবার যেহেতু করোনাকাল তাই অন্যবারের তুলনায় বেশি করে সাহায্য-সহযোগিতা করা দরকার, যতটুকু সামর্থ্য আছে তার সর্বোচ্চটা করা দরকার। আর যারা হাত পাতে তাদের জন্য শুধু নয়, যারা হাত পাতে না, কিন্তু অবস্থা হয়তো হাত পাতা লোকটার মতো কিংবা তার চেয়েও করুণ তাদের খুঁজে বের করা, সরাসরি না নিতে চাইলে কৌশলে দিন- কারণ তিনি করোনাপীড়িত নতুন দরিদ্র, হাত পাততে অভ্যস্ত নয় বলে লজ্জা লাগে- তাই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন কিন্তু মুখ ফুটে দুটো টাকা সাহায্যের কথা বলতে পারছেন না।
করোনাপীড়িত নতুন দরিদ্রদের ঈদ কেমন হবে তা নিয়ে সামাজিক কোনো উদ্যোগ নেই, রাষ্ট্রের কোনো আয়োজন নেই, প্রশাসনের তরফে কোনো কর্মসূচি নেই, ব্যক্তির পক্ষে কোনো ঘোষণা নেই- তা হলে তারা কোথায় যাবে, কী করবে- তা হলে তাদের ঘরে ঈদের চাঁদের হাসি-খুশির বারতা কি হবে না হাজির?
ঈদের দিন কাছে আসছে, আর করোনায় সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। কত মানুষ প্রিয়জন হারিয়ে গভীরতর এক দুঃখে আচ্ছন্ন। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পুরো পরিবারই হয়তো বাস্তবিকই পথে বসতে বসেছে। এই অবস্থায় কারও ঈদ আনন্দের প্রকাশ যেন অন্যের দুঃখের কারণ না হয়- অন্যের কান্নাকে আরও বেশি আর্দ্র না করে তোলে।
করোনাকালের ঈদ যেন শুধু সময়ের কারণে ইতিহাসের দলিল না হয়ে ওঠে। ঈদ উদ্যাপন ও আনন্দোৎসব ভাগাভাগি করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে হয়ে উঠুক স্মরণীয়-বরণীয় এক ঈদ। সমাজ-রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠান যখন কিছু করে তখন তার সঙ্গে প্রদর্শনের ব্যাপারটাও যুক্ত হয়ে যায়। এটা হয়তো তাদের বাস্তবতা ও চারিত্রিক কাঠামোরই বহির্প্রকাশ। ব্যক্তির ক্ষেত্রে এসব না থাকাই শ্রেয় ও নন্দনযোগ্য। এটা থাকলে ব্যক্তির মনোযোগ খন্ডিত হয়ে যায়। ভালোবাসা-পাশে থাকা-হাতে হাত রাখা সর্বোপরি সঙ্গে থাকা-খন্ডিত কোনো কর্ম নয়, করোনাকালের ঈদুল আজহায় এই প্রার্থনা, ‘খন্ডিত কর্ম’ থেকে মুক্ত হোক বাঙালি মুসলমান।
ড. কাজল রশীদ শাহীন : সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক