অনিন্দিতা কাজী /
কাজী নজরুল ইসলামকে আমরা শ্রদ্ধা করি। ভালোবাসি তাঁর গান-কবিতা-গল্প-উপন্যাস। তাঁর লেখার ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গিতে যেন আগুন ঝরে। তিনি সকলের মনের কথা টেনে বের করে যেন শব্দ-অক্ষরে ছড়িয়ে দিয়েছেন। ঝরনাধারার মতো তার গতি, সাগর কল্লোলের মতো আবেগময়। মাটির মানুষের জন্য দুখু মিয়াঁর মমতা ছেলেবেলা থেকেই। রানিগঞ্জের সিয়ারশোল রাজ স্কুলের ছাত্র তখন তিনি। স্কুলে পড়ার সময় ক্লাসের কড়িকাঠের ফাঁকে চড়ুই পাখি বাসা বেঁধেছিল। পাখির একটা ছোট্ট ছানা উড়তে গিয়ে নীচে পড়ে যায়। পালানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। একটা ছেলে লম্বা সুতো অসহায় পাখিটার পায়ে বেঁধে খেলা শুরু করল। নজরুল ছেলেটাকে বললেন, পাখিটাকে ছেড়ে দিতে। সে পাখিটাকে ছাড়ল না, বরং নানাভাবে তাকে উত্ত্যক্ত করতে লাগল। দুখু সকলের অলক্ষে বাইরে গিয়ে কাঁধে করে একটা মই এনে ভীত পাখির বাচ্চাটাকে বাসায় তার মায়ের কাছে পৌঁছে দিলেন। এমনই কোমল ও স্পর্শকাতর ছিল তাঁর মন। সেই রাতেই তিনি কবিতা লিখলেন – চড়ুই পাখির ছানা।
ৃমই এনে সে ছানাটিরে দিল তাহার বাসায় তুলে / ছানার দুটি সজল আঁখি করলে আশিস পরান খুলে। / অবাক নয়ন মাটি তাহার রইল চেয়ে পাঁচুর পানে, / হৃদয়-ভরা কৃতজ্ঞতা দিল দেখা আঁখির কোণে। / পাখির মায়ের নীরব আশিস যে ধারাটি দিল ঢেলে, / দিতে কি তার পারে কণা বিশ্বমাতার বিশ্ব মিলে! একবার গ্রামে কিছু মুসলমান ফকির গাছতলায় ডেরা বাঁধলেন। খবর পেয়ে এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বেশ অনেকটা দূরে ফকিরদের সেই আড্ডায় গেলেন দুখু। ফেরার পথে শুরু হল তুমুল ঝড়-বৃষ্টি। দুই বন্ধু দৌড়োতে শুরু করলেন। হঠাৎ জলে-কাদায় বন্ধুটি পা পিছলে পড়ে গেলেন। হাত-পা কেটে রক্ত বেরোতে লাগল। নিজের কাপড় ছিঁড়ে বন্ধুর ক্ষতস্থান বেঁধে দিলেন দুখু। তারপর কোনওরকমে যে যার বাড়ি পৌঁছোলেন। খানিক বাদে কিছু গাছের পাতা নিয়ে দুখু সেই বন্ধুর বাড়ি হাজির। এত রাতে তাঁকে দেখে বন্ধু তো অবাক! দুখুর হাতে ছিল নিমপাতা। নিমগাছটি ছিল খ্রিস্টানদের কবরখানার পাশে। বন্ধু বললেন, কবরখানায় ভূত আছে, জানো? দিনেরবেলা মানুষ ওখানে যেতে ভয় পায় আর তুমি কিনা এত রাতে ওখানে গেলে! দুখু উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে বললেন, ভূত না তোর মাথা! এরপর বন্ধুর ক্ষতে নিমপাতা লাগিয়ে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে গেলেন তিনি।
আসানসোলে এক রুটির দোকানে দাদু যখন কাজ করতেন, তখন এক খোঁড়া ভিক্ষুককে প্রায়ই দেখতেন। দুঃখে-সুখে তিনি সর্বদা নির্বিকার, মুখে তাঁর সবসময় হাসি। নজরুল তাঁকে কখনও খাবার, কখনও আর্থিক সাহায্য করতেন। যেদিন তিনি মারা গেলেন, নজরুল কষ্টে মুষড়ে পড়লেন। বাজারের সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলে ওই ভিক্ষুকের শেষকৃত্য সম্পন্ন করলেন। তাঁর স্মরণে গানও লিখলেন। ৃপাওনি দরদী বন্ধু জগৎ খুঁজি / দুঃখেতে তাই মুখটি রাখিতে বুজি / তুমি জেনেছিলে মোরে আপনজন / তাই তবে লাগি কাঁদিতেছে মোর মন।ৃ কবিবন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় স্মৃতিচারণায় লিখছেন, কৈশোরে একবার নজরুলের ডেরায় গিয়ে তিনি দেখেন, কাচের প্লেটে কয়েক মুঠো ভাত ও মাংসের ঝোল দিয়ে নজরুল খেতে বসেছেন। যে দুটো ডেকচিতে রান্না হয়েছিল, তাতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। এর আগে নজরুলের কাছে একজন এসেছিলেন টাকা ধার করতে। ২০/২৫ বছরের রান্নার ছেলেটা নজরুলের সামনে এক গ্লাস জল রেখে বলল, সে হোটেলে খেতে যাচ্ছে। তখন নজরুল তাকে প্রশ্ন করেন, বাড়ির খাবার না খেয়ে সে কেন হোটেলে খেতে যাচ্ছে? তখন ছেলেটা বলল, আপনি তো বন্ধুকে সব খাইয়ে দিলেন। নজরুল বললেন, দূর! ও আমার বন্ধু নয়, এসেছিল টাকা ধার করতে। আমার নামডাক শুনে ভেবেছিল আমার মেলা টাকা! দেখলাম বেচারার মুখটা শুকিয়ে গেছে। বললে, দুদিন ভাত খাইনি।
রাঁধুনি ছেলেটা বলল, আমার খেতে যেতে হত না, যা রান্না করেছিলাম, তাতেই কুলিয়ে যেত। কিন্তু তিনজনের খাবার লোকটা একাই খেয়ে ফেলল। নজরুল বললেন, ধ্যাত, ওরকম বলতে নেই। আমি ওর মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, বেচারার খুব খিদে পেয়েছে। খেয়েছে, বেশ করেছে। এরপর ওই লোকটিকে তাঁর নিজের শেষ সম্বল দশটি টাকা দিয়ে বিদায় করেন। এজন্যই তিনি অন্যের থেকে আলাদা। স্বার্থবিমুখ নজরুল ইসলাম কোনওদিন পরার্থপরতায় পরাঙ্মুখ ছিলেন না। নজরুলের শুভানুধ্যায়ী নলিনীকান্ত সরকারের লেখা একটা ঘটনা বলি। দক্ষিণ কলকাতায় নজরুলের পরিচিত দুঃস্থ এক কন্যার বিয়ে হবে। কন্যাপক্ষ নজরুলের পূর্বপরিচিত। কোনওরকমে দায় নির্বাহ করার কাজ চলছে। একদিন সন্ধ্যাবেলায় গাড়ি নিয়ে নলিনীকান্ত সরকারের বাড়ি হাজির হলেন নজরুল। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বেঙ্গল স্টোর্স-এর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। হিন্দু বিয়ের লৌকিকতার সঙ্গে নজরুল বিশেষ পরিচিত ছিলেন না। তাই নলিনীকান্তকে সঙ্গে নিয়ে ফুলশয্যার তত্ত্বের জিনিস কিনে গাড়ি বোঝাই করে সে সব সামগ্রী কন্যার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এলেন।
দাদু অসুস্থ হওয়ার পর সেই দুর্দিনে কবির পরিবারকে নানাভাবে বাঁচিয়েছিলেন তাঁর বিশিষ্ট বন্ধু যোগীবর কালীপদ গুহ। তিনি এক চমকপ্রদ ঘটনার কথা বলেছিলেন। ১৯৪১ সালে রাজনৈতিক পত্রিকা নবযুগ-এর জন্মের সময় থেকেই সম্পাদকের দায়িত্ব নেন নজরুল। কালীপদ গুহ ছিলেন মহাসম্পাদক। এই পত্রিকার বড় আকর্ষণ ছিল দাদুর লেখা প্রবন্ধ, যার একদিকে থাকত রসবৈচিৎর্য, আরেকদিকে থাকত বিদ্রোহী বাণী। মাঝে মাঝে দাদু তাঁর পৌরুষদৃপ্ত কবিতায় সম্পাদকীয় বক্তব্য প্রকাশ করতেন। সুনীল রায় নামে নবযুগের এক কর্তা তাঁর দুষ্ট স্বভাবের জন্য কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হন ও গুরুতর ত্রুটিবিচ্যুতি ধরা পড়ার ফলে প্রেসের চাকরিটি খোয়াতে হয়। তিনি তখন নজরুলের শরণাপন্ন হন। দাদুকে গিয়ে বলেন, কাজীদা, আপনি এর বিহিত করুন। স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে আছে। এরা কি না খেতে পেয়ে মরবে?
ব্যাকুল হয়ে দাদু বললেন, না না, সেকি কথা! ওদের কখনও কষ্ট দিও না। সুনীল দাদুকে বলল, তাহলে দেখুন, চাকরিতে আবার যেন আমি বহাল হতে পারি। দাদু বললেন, তা তো সম্ভব নয় রে ভাই। নজরুল জানেন সুনীলের অপরাধ কতটা গুরুতর। পরিচালকরা কিছুতেই তাঁকে মাফ করবেন না। কিছুক্ষণ চিন্তা করে পানের ডিবে থেকে দুখিলি পান মুখে পুরলেন। তারপর হঠাৎ কর্মীটির অন্ন সমস্যার একটা সহজ উপায় বের করে কিছুটা উল্লসিত হলেন এবং চেয়ার থেকে উঠে সস্নেহে সুনীলের হাত ধরে দক্ষিণের জানলার কাছে টেনে নিয়ে গেলেন। ফিশফিশ করে তাঁকে একটা প্রস্তাব দিতে তিনি মহাখুশি হয়ে দাদুকে ভক্তিভরে প্রণাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দাদু বললেন, যাক, বাঁচা গেল। ব্যবস্থা একটা হল। ছেলেমেয়ে নিয়ে বেচারাকে আর উপোস করতে হবে না।
মাসতিনেক পরের কথা। সুনীল নামে সেই লোকটা দাদুর চেয়ারের সামনে যেতেই তিনি তাঁকে পশ্চিমের বারান্দায় নিয়ে গেলেন। কিছু কথাবার্তার পর তিনি দাদুকে প্রণাম করে চলে গেলেন। প্রতি মাসের প্রথমে ছেলেটি কেন আসে, কালীপদ গুহ রায় একদিন দাদুকে জিজ্ঞাসা করলেন। সেদিনই গিরিবালা দেবী (নজরুল ইসলামের শাশুড়ি) কালীপদবাবুকে জানিয়েছেন, দাদু বাড়িতে নিয়মিত টাকাপয়সা দেন না। অথচ সবাইকে গোপন করে তিনি নিজের মাইনে থেকে মোটা অঙ্কের টাকা বেকার সুনীলকে দিয়ে যাচ্ছেন তাঁর পরিবারকে বাঁচাতে। কালীপদবাবু দাদুকে বোঝালেন, কর্মঠ লোককে বেকার ভাতা দিলে তাঁর কাজ করার ইচ্ছে চলে যায়। তাই বেকার ভাতা বন্ধ করে দিতে বললেন। তারপর দাদুর মাইনের টাকা সরাসরি বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন কালীপদবাবু।
পোশাকি ব্যবহার কিংবা লোকদেখানো সৌজন্য জানতেন না দাদু। মনে যা ভাবতেন, মুখে তা বলে দিতেন চটপট। কে কী মনে করবেন, তা ভাবার মতো অবকাশ ছিল না তাঁর। সেজন্য তাঁকে জীবনে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তাই বলে কেউ দুঃখ পান, এমন ব্যবহার দাদু কখনও কারও সঙ্গে করেননি। দাদুর গানের সংখ্যা অনেক। যখন তিনি গ্রামোফোন কোম্পানির ট্রেনার ছিলেন, তখন অনেকে তাঁর অনেক গান গ্রামোফোন কোম্পানির খাতা থেকে নিয়ে গিয়ে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন। জেনেশুনেও তিনি উদাসীন থাকতেন। এই নিয়ে তাঁর মধ্যে কোনও উত্তেজনা ছিল না। শুভানুধ্যায়ীরা থাকতে না পেরে একটি ঘটনা উল্লেখ করে একদিন তাঁকে বললেন, কাজীদা, ওই গানগুলো তো আপনার, ও নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছে, দেখেছেন? চিন্তাভাবনা না করে দাদু জবাব দিলেন, চুপ চুপ! শুনতে পেলে বেচারি দুঃখ পাবে, লজ্জায় পড়বে।
তাঁর এই উত্তরে সহকর্মীদের মুখের চেহারা দেখে অসহায়ভাবে খানিকটা সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে দাদু বললেন, থাকগে, ওর থেকে আরও কত ভালো গান লিখব আমি। তোরা ভাবিসনি। সমুদ্র থেকে এক গণ্ডূষ জল তুলে নিলে কি সমুদ্র শুকিয়ে যায়? এমনই কল্পতরু ছিলেন দাদু। নজরুল ইসলামের কাছে মানুষের চেয়ে বড় আর কিছুই ছিল না। কখনও কেউ তাঁর কাছে এসে হাত পাতলে তিনি পকেট ঝেড়ে সব দিয়ে দিতেন। অভাবের সংসারেও তাঁর হাতে পয়সা থাকত না। তবু মানুষকে ভালোবাসা, তাঁদের আনন্দ দেওয়াতেই ছিল তাঁর তৃপ্তি। তাঁর দর্শন ছিল, জীবন আমার যত দুঃখময় হোক, আনন্দের গান, বেদনার গান, গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাব নিজেকে নিঃশেষ করে সবার মাঝে বিলিয়ে ৃসবার বাঁচার মাঝে থাকব আমি বেঁচে। সকল দীনতা-হীনতা কাটিয়ে তাঁর সৃষ্টির উদার আকাশ আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখুক সদা। এই প্রার্থনা থাকুক উত্তরসূরিদের।
(লেখিকা কাজী নজরুলের কনিষ্ঠ পৌত্রী)