জাফর আহমদ/
রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর সেক্টরে বাজারে যেতে ১০০ গজের মধ্যে তিনজন ভিক্ষুকের মুখোমুখি হতে হলো। তিনজনের দুজনই বয়স্ক নারী, তার নাম অঞ্জনা বেওয়া। এক হাত দিয়ে আঁচল দিয়ে লজ্জাবনত মুখ ঢাকা। অন্য হাতে সাহায্য চেয়ে চলেছেন। জিজ্ঞেস করতেই তিনি জানালেন কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের আগে দোকানে দোকানে পানি পৌঁছে দিতেন। এর বদলে পারিশ্রমিক পেতেন। করোনার সময় দোকান বন্ধ হয়েছিল। এরপর আর কাজ পাননি। অঞ্জনা বেঁচে থাকার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
বৈশ্বিক মহামারী করোনার অভিঘাতে নিম্নআয়ের অঞ্জনারা সামান্য আয়ের উৎসটাও হারিয়ে ফেলেছেন। ফকিরাপুলের হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের কর্মী আসগর মার্চ মাসে চাকরি হারিয়েছিলেন। করোনার তীব্রতা কমে গেলে সেপ্টেম্বর মাসে হোটেলের চাকরিটি ফিরে পেয়েছেন কিন্তু তিন মাসে বেতন মিলেছে মাত্র একমাসের। দ্বিতীয় সারির দৈনিক সংবাদপত্রের কর্মী মহর আলী তার অফিস থেকে সাত মাসের বেতন পাবেন। মহর আলীর অফিস করোনার পিক-টাইমে কমবেশি প্রতি মাসে বেতন দিতে পারলেও গত তিন মাস ধরে বেতন দিতে পারছে না। পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে, বাসা ছেড়ে নিজে মেসে উঠেও খরচ সামাল দিতে পারছেন না মহর। মাস শুরু হলেই খাওয়ার বিল আর মেস ভাড়ার টাকার জন্য আত্মীয়স্বজনের দ্বারস্থ হন। বাড়িতে টাকা পাঠানোর তাগাদা বাড়ে। বিব্রত, লজ্জিত ও অপমানিত হয়েও পার পাচ্ছেন না। কারণ, তার সামনে কোনো পথ খোলা নেই।
একই অবস্থা করোনার আগে ৬০ হাজার টাকা বেতন পাওয়া ব্যাংক কর্মকর্তা আবির হোসেনের। করোনার কারণে চাকরি হারিয়ে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার উপক্রম। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হার সর্বোচ্চ থাকাকালীন সময়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনার মহামারীর কারণে দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৩৫ শতাংশে উঠেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে আয় ও ভোগের বৈষম্য। ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয় ও ব্যয় হিসেবে দেশে দরিদ্রের হার ছিল ২৪ শতাংশ। আর ওই হিসেবের ভিত্তিতেই ২০১৯ সালে দরিদ্রের হার কমে ২০ শতাংশ অনুমিত হয়। করোনার কারণে মাত্র তিন মাসে দারিদ্র্যের হার লাফ দিয়ে দিয়ে তিন চতুথাংশ বেড়ে ৩৫ শতাংশে পৌঁছে গেল।
দারিদ্র্যের হার বাড়ার এই সরলীকরণ বাস্তবে করার সুযোগ নেই। যে মধ্যম আয়ের ছিল তারা আয়-রোজগার হারিয়ে দরিদ্র হয়েছে। আর দরিদ্ররা অতি দরিদ্রে পরিণত হয়েছে। মোটামুটি রোজগারের মহর আলী বা আবির হোসেন করোনাঘাতে আয় এবং সমাজ দুই থেকেই চ্যুত হয়েছেন। করোনা মহামারী আয়-রোজগার হারানোর পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতারও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা শহরে আয়-রোজগার হারিয়ে গ্রামে চলে গেছে তারে অনেকেই কাজ পায়নি। বা পেলেও সে যে কাজ পারে সে কাজ পায়নি। যা পেয়েছে তাতে কোনোমতে দুবেলার খাওয়ার জুটছে।
এর ফলে এসব গ্রামে ফেরা মানুষ সামাজিক অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই অস্থিরতা নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করছে। বিআইডিএস এর গবেষণা পরিচালক ড. জায়েদ বখত খোলা কাগজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, করোনায় কর্ম হারিয়ে মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছে। গত কয়েক বছরে মানুষ বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে আশাব্যঞ্জকভাবে অবস্থান নিয়েছিল।
বাল্যবিয়ে, শিশু মৃত্যুহারের মতো সামাজিক অগ্রগতি হয়েছিল। করোনার কারণে কর্মসংস্থান ও আয়-রোজগার হারানোর কারণে আবার বাল্যবিয়ে বেড়ে গেছে। সারা দেশ থেকে বাল্যবিয়ের খবর আসছে। বাবা-মা চিন্তা করছে বিয়ে দিলেই নিরাপত্তা তৈরি হবে। খবর আসছে পারিবারিক সহিংসতারও।
করোনার কারণে নতুন করে কোনো উদ্যোক্তা বিনিয়োগ করার জন্য এগিয়ে আসছে না। গত অর্থবছরে মুদ্রানীতিতে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ বেসরকার খাতে বিনিয়োগের জন্য লক্ষ্য স্থির করা হলে করোনার কারণে বড় ধরনের থাক্কা খায়। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে একই লক্ষ্য স্থির করলেও বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। অন্তত প্রথম প্রান্তিকে বাংলাদেশের প্রতিবেদনে এমন চিত্রই উঠে এসেছে। বরং আরও সঙ্কুচিত হচ্ছে। পুরনো ব্যবসা-বাণিজ্য ধরে রাখতেই প্রাণান্ত হচ্ছে উদোক্তারা।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের (ডিআইএফই) তথ্য অনুযায়ী মোট ১৫ হাজার ৯৬৫টি কারখানা ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে গার্মেন্ট কারখানা এক হাজার ৯১৫টি এবং গার্মেন্টের বাইরে অন্যান্য খাতের কারখানা ১৪ হাজার ৫০টি কারখানা ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ সব কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে ১০ লাখ ৫১ হাজার শ্রমিক কর্মরকত ছিলেন। এর বাইরেও গত কয়েক মাসে ৮৭টি কারখানা থেকে প্রায় সাড়ে ২৬ হাজার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে গার্মেন্ট কারখানার সংখ্যা ৭৫টি। এসব শ্রমিকের বেশির ভাগই বর্তমানে বেকার। কাজ হারানো মানুষের লাইন শিল্প-কারখানা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে কোথাও বাকি নেই। সেই সঙ্গে প্রতি বছর ২০ লাখ করে তরুণ কর্মবাজারে ঢোকার জন্য প্রস্তুত হয়, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি প্রলম্বিত হওয়ার কারণে তারাও এখন সামনে। নতুন করে কর্মসংস্থান বন্ধ থাকার কারণে সামাজিক বার্ডেন প্রতি দিনই ভারী হচ্ছে।
কোভিড-১৯ এর ভয়ঙ্কর অন্ধকারের মধ্যেই আশার আলো ধরে রেখেছে কৃষি, প্রবাসী আয়, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ও রপ্তানি আয়ে। করোনা মহামারীর কারণে পুরো বিশ্ব যখন ছুটিতে। বিশ্বখাদ্য সংস্থা যখন বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করছে, সরকার খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সুযোগের সবটুকু কাজে লাগানোর পরামর্শ দিচ্ছে। তখন বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষক জেগে ছিল। খাদ্যের জোড়ান দিয়েছে; খাদের জোগান দিয়ে চলেছে। অন্যদিকে প্রবাসে নতুন করে কর্মী না গেলেও ও রপ্তানি আয়ে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যয়ের সংশ্লেষ না থাকলেও এসব খাত অর্থনীতিকে চাঙ্গা রেখেছে। করোনার মধ্যেই সরকারের প্রণোদনা ঘোষণা ও বাস্তবায়ন উদ্যোক্তারা সুযোগ হিসাবে নিয়েছে।
পাশাপাশি করোনার পিক টাইমের মধ্যেই কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া, বিভিন্ন এলাকায় লকডাউন পর্যায়ক্রমে তুলে নেওয়া, যোগাযোগ ও বিপণন কেন্দ্রগুলো থেকে লকডাউন শিথিল করার মধ্য দিয়ে মানুষকে কর্মে নিয়োজিত সাহস জোগায়। এর মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক স্পন্দন ফিরে আসা শুরু করে। অর্থনৈতির এই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় বাংলাদেশ আশপাশের দেশগুলোর চেয়ে অগ্রগামী বলে ইতিমধ্যে মন্তব্য করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। আন্তর্জাতিক এই অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানটি ভারতকে পিছিয়ে ফেলে করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রশংসাও করতে ছাড়েনি।
ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরবিআই-এর সাম্প্রতিক মন্তব্য করোনার আঘাতের চিহ্ন ফুটে উঠেছে। ভারতের চলতি অর্থবছরে প্রথম প্রান্তিক এপ্রিল-জুনের অর্থনীতি ২৪ শতাংশ হ্রাস পায়। চলতি মাসে অর্থনীতির দ্বিতীয় প্রান্তিক জুন-সেপ্টেম্বরের পরিস্থিতি নিয়ে আরবিআই-এর প্রকাশিতব্য প্রতিবেদনে ভারতের অর্থনীতি নতুন করে আরও ৮ দশমিক ৬ শতাংশ সঙ্কুচিত হয়েছে। ভারতের আর্থিক এ অবস্থাকে ‘টেকনিক্যাল মন্দা’ হিসেবে অবিহিত করছে। এ অবস্থার উন্নতি না হলে ভারত স্থায়ী মন্দা অবস্থায় দিকে ধাপিত হবে। বাংলাদেশে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে অর্থনীতি ইতিবাচক ধারায় ছিল। জুন- সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভারতের আরবিআইয়ের মতো সাহসী উচ্চারণ করতে না পারলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ইতিবাচক ধারাতে আছে।
করোনার আঘাকে বিপর্যস্ত প্রান্তিক মানুষ অঞ্জনা বেওয়া, কর্মহারানো ব্যাংক কর্মকর্তা আবির হোসেন বা বেতন না পাওয়া মহর আলী যে বার্তাই দিক না কেন, খুব ভালো নেই বাংলাদেশের অর্থনীতি।
সরকার ঘোষিত প্রণোদনা অর্থনীতির ট্রিটমেন্টে সুশাসন ও উদ্যোক্তাদের আন্তরিকতা থাকলে করোনার অভিঘাত থেকে উত্তরণ খুব একটা কঠিন হবে না।