বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) থেকে কোটা পদ্ধতির অবসান হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৪৮ বছর ধরে চলা কোটা পদ্ধতি স্থায়ীভাবে বিলুপ্ত হলো। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ফলাফল প্রকাশিত ৩৮তম বিসিএসে কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এর মাধ্যমে কোটা অধ্যায়ের সমাপ্তির মাধ্যমে মেধার যুগে প্রবেশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)।
কোটা বহালের কারণে বিগত ২৮ থেকে সর্বশেষ ৩৮তম বিসিএসে ৬ হাজার ক্যাডার পদ শূন্য পড়ে ছিল। আগামী ৪০তম বিসিএস থেকে শতভাগ মেধায় নিয়োগ দেবে পিএসসি। ২০১৮ সালে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে কোটা প্রথা বিলুপ্ত করে সরকার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিএসসির চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক ইত্তেফাককে বলেন, ‘৩৮তম বিসিএসের মধ্য দিয়ে কোটা পদ্ধতির অবসান হয়েছে। ৪০তম বিসিএসে সরকারের সর্বশেষ কোটা নীতি অনুসরণ করা হবে। বর্তমানে সরকার কোটা বিলুপ্ত করেছে। ফলে কোটা নিয়ে সরকার যেভাবে সিদ্ধান্ত দেবে আমরা সেটা অনুসরণ করব। মোদ্দা কথায়, ৪০তম বিসিএস থেকে কোটা থাকছে না।’
২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর মন্ত্রিসভায় কোটা বাতিলের প্রস্তাব অনুমোদন হওয়ার প্রায় এক মাস আগে ১৯০৩টি পদে নিয়োগের জন্য ৪০তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি জারি করে পিএসসি। এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেওয়া প্রায় ২০ হাজার প্রার্থী এখন ফলের অপেক্ষোয় আছে। ৪০তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, ফলাফল দেওয়ার সময় সরকারের সর্বশেষ কোটা নীতি ব্যবহার করা হবে।
তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কোটার কারণে বিসিএসে মেধাবীরা উত্তীর্ণ হলেও একদিকে চাকরি পাননি, অন্যদিকে শত শত পদ শূন্য থাকত। পিএসসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া যাওয়ায় ২৮ থেকে ৩৮তম বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারে অন্তত ৬ হাজার পদ খালি ছিল। এমনকি শুধু কোটার প্রার্থীদের নিয়েগের জন্য ৩২তম বিশেষ বিসিএস নেওয়া হলেও ঐ বিসিএসেও মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৮১৭টি, মহিলা ১০টি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ২৯৮টিসহ মোট ১ হাজার ১২৫টি পদ শূন্য রাখতে হয়। কোটায় পদ পূরণ না হলেও তা সংরক্ষণ করে রাখার নিয়ম ছিল। তবে ৩২তম বিসিএসে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পদ খালি থাকায় কোটার শূন্য পদ সংরক্ষণ করে রাখা নিয়ে পিএসসিতে প্রশ্ন ওঠে। এরপর যোগ্যতা সাপেক্ষে পিএসসি ৩৩তম বিসিএস থেকে কোটা কিছুটা শিথিল করে। কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় ৩৩তম বিসিএসে ৭৭ দশমিক ৪০ শতাংশ, ৩৫তম বিসিএসে ৬৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং সর্বশেষ ৩৬তম বিসিএসে ৭০ দশমিক ৩৮ শতাংশ মেধাবী নিয়োগ পান। এই তিন বিসিএস থেকে ৭১ দশমিক ৭৫ শতাংশ মেধাবী নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হন। শুধু বিসিএস নয়, সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও কোটার কারণে পদ শূন্য পড়ে থাকত।
সর্বশেষ ৩৮তম বিসিএসে ২ হাজার ২০৪জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। তবে এর মধ্যে কত শতাংশ কোটায় নিয়োগ পেয়েছেন তা উল্লেখ করেনি কমিশন। পিএসসি বলছে, ৫৫ শতাংশ কোটা এবং ৪৫ শতাংশ মেধা—এই নিয়ম মেনে ৩৮তম বিসিএসের ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। তবে সাধারণ ক্যাডারে কোটার সব প্রার্থী পাওয়া গেলেও কারিগরি ক্যাডারে কোটার প্রার্থী যেখানে পাওয়া যায়নি, সেখানে সাধারণ প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। বিসিএসে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পররাষ্ট্র ক্যাডারে এবার ২৫ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। এই ২৫ জনের বেশির ভাগ চিকিৎসক ও প্রকৌশলী।
যেভাবে কোটা প্রথার উদ্ভব :সংবিধানের ২৯ (৩) (ক) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশকে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভের উদ্দেশ্যে তাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করতে পারে মর্মে অনুশাসন প্রদান করা হয়েছে। সংবিধানের উপরিউক্ত অনুশাসনের আলোকে নাগরিকদের অনগ্রসর অংশকে অগ্রগতির মূল স্রোতধারায় আনার জন্য স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে এক নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সিভিল সার্ভিসে ২০ শতাংশ পদ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের বিধান ছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৬ সালে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশে উন্নীত করা হয়। ১৯৮৫ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে মেধার ভিত্তিতে ৪৫ শতাংশ নিয়োগের বিধান প্রবর্তন করা হয়। অবশিষ্ট ৫৫ শতাংশের মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, ১০ শতাংশ মহিলা, ১০ শতাংশ জেলা এবং ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে বণ্টনের ব্যবস্থা করা হয়, যা চলমান রয়েছে। ২০১২ সাল থেকে বিদ্যমান কোটাসমূহের মধ্যে যে কোটায় পর্যাপ্তসংখ্যক যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যাবে না, সেই কোটা থেকে ১ শতাংশ পদ প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের দ্বারা পূরণের বিধান রাখা হয়। ( সূত্র- ইত্তেফাক)