জাফর আহমদ /
করোনার অভিঘাত মোকাবিলায় চার শতাংশ সুদ হারে কৃষকদের দেওয়ার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা স্কিম গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ঋণ বিতরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করে ৪৩ বাণিজ্যিক ব্যাংক। নির্দিষ্ট সময়ে অতিক্রম করলেও পুরোপুরি বিতরণ করতে পারেনি এসব ব্যাংক। এর মধ্য ২১ ব্যাংকের বিতরণ খুবই অল্প। দুই ব্যাংক বিতরণই করেনি। এ সব ব্যাংকের বিরুদ্ধে কৃষকের টাকা আটকে রাখার অভিযোগ করা হয়েছে। এ সম্পর্কিত চিঠি ১৯ বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর কাছে পাঠানো হয়েছে।
এ সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর কাছে পাঠানো চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে থেকে বলা হয়, নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সৃষ্ট আর্থিক সংকট মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ‘কৃষি খাতে বিশেষ প্রণোদনামূলক ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল’ থেকে আপনাদের অনুকূলে কৃষি খাতসমূহে ৪ শতাংশ সুদ হারে ঋণ বিতরণ করতে বলা হয়েছিল। এই ঋণ বিতরণের জন্য আপনারা স্বপ্রণোদিত হয়ে পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গ্রহণের জন্য অংশগ্রহণ চুক্তি করেছিলেন। কিন্তু ৩০ সেপ্টেম্বর ঋণ বিতরণের সময় শেষ হলেও আপনাদের বিতরণের হার যত সামান্য। যা জাতীয় অর্থনৈতিক সংকটকালে কৃষিঋণ বিতরণ না করে তহবিল আটকে রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশনা লংঘনের শামিল। একই সঙ্গে সরকারের ঘোষিত খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অসহযোগিতার শামিল।
প্রণোদনার কৃষিঋণ আটকে রাখার যে সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক সেগুলো হলো- বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক, সীমান্ত ব্যাংক, সাউথ ইস্ট ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার এন্ড কমার্স ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক। এ সব ব্যাংকের আটকে রাখা প্রণোদনার কৃষিঋণের পরিমাণ ৭৩৭ কোটি টাকা। এ সব ব্যাংক প্রণোদনার কৃষি ঋণ বিতরণ বিতরণ করবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করেছিল এবং লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। এ সব ব্যাংক ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার দশমিক ৪৪ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ পর্যন্ত বিতরণ করে। মধুমতি ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংক বিতরণ শুরুই করেনি।
করোনা মহামারী শুরু হলে অর্থনীতির সব খাত বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। এ সময় বিশ^খাদ্য সংস্থা খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে সতর্কতা জারি করে। বৈশি^ক মহামারীর প্রেক্ষাপটে সরকার খাদ্য নিরাপত্তা ও পল্লী অঞ্চলে যে কোনো মূল্যে কর্মচঞ্চলতা ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করে। এর অংশ হিসেবে ‘কৃষি খাতে বিশেষ প্রণোদনামূলক ৫০০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল’ ও ফসলে আরও এক হাজার ১১৩ কোটি টাকার ৪ শতাংশ সুদ হারে দুটি ভিন্ন স্কিম গঠন করে। এর বাইরে ৯ শতাংশ হারে আর প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা বছরজুড়ে বিতরণের কর্মসূচি আছে-সে কর্মসূচিও জোরদার করে। যাতে ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি পল্লী অঞ্চলে কর্মচঞ্চল্য ধরে রাখা যায়। কিন্তু পাঁচ হাজার কোটি টাকা স্কিমের মেয়াদ ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়। যাতে করোনার অভিঘাত মোকাবিলায় এই ঋণ সহায়তা করে। কিন্তু চার মাসে মাত্র এক হাজার ৮৯২ কোটি বা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৪৩ শতাংশ বিতরণ করে। ২১ ব্যাংকে বিতরণ করে নামে মাত্র।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষি বিভাগ মনে করছে এ সব ব্যাংক চুক্তি করে বিতরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে কৃষকদের মাঝে ৪ শতাংশ হারে বিতরণের অর্থ আটকে রেখেছে। আবার বিতরণও করছে না। ফলে এ ঋণ বিতরণে তাগাদা দেওয়ার পাশাপাশি আরও তিন মাস সময় বর্ধিত করে। এই তাগাদার অংশ হিসাবে কম ঋণ বিতরণ করা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের চিঠি দেওয়ার পাশাপাশি ফোনে মনিটরিং শুরু করেছে।
এ বিষয়ে মধুমতি ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকরুল আলম ও সফিউল আযমের সঙ্গে খোলা কাগজের কথা হয়। ব্যাংক প্রণোদনার কৃষিঋণ বিতরণ শুরুই করতে পারেনি। নেতৃদ্বয় বলেন, করোনার কারণে পুরোপুরি ব্যাংক চালু রাখা যায়নি এবং তাদের পল্লী অঞ্চলে শাখার সংখ্যাও কম। এ কারণে তারা প্রণোদনার কৃষি ঋণ বিতরণ করতে পারেননি। পরবর্তী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বর্ধিত করা হয়েছে, এ সময়ের মধ্যে তারা শুরু করতে পারবে। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইলে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষিঋণ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, করোনার মধ্যে সব ব্যাংক একইভাবে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছে। এখনো করে যাচ্ছে। তারাও প্রণোদনার কৃষিঋণ বিতরণ করছে। কিছু ব্যাংক তাদের মনোভঙ্গিগত সমস্যার কারণে কৃষি ঋণ বিতরণে আগ্রহী দেখায়। তারা দেশের কৃষি, কৃষক ও দেশের সরকারের খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির সঙ্গে এ সহযোগিতার অংশ হিসেবে কৃষিঋণ বিতরণ করতে পারে। কিন্তু তারা করে না। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও এ সব ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণে অনীহা দেখায়। সাধারণ কৃষি ঋণ বা মোট ঋণের ২ শতাংশ কৃষকদের মাঝে বিতরণের যে লক্ষ্যমাত্রা আছে সেখানেও কিছু ব্যাংক অনীহা দেখায়।