করোনা , আম্পান ও তিনদফা বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছেন দেশের কৃষক। দুর্যোগ তাঁদের পিছ ছাড়ছে না। আম্পান যায়, বন্যা আসে। ডুবে যায় বাড়ি-ঘর, ফসলের মাঠ। এবছর বন্যায় প্রায় ২৬ হাজার হেক্টর জমির পাট ফসল ডুবে গেছে। সরকারি পাটকলগুলো বন্ধের পর পাটের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার এক অজনা আতঙ্ক বিরাজ করছিল পাট চাষিদের মধ্যে। সারা দেশে চাষকৃত পাটের শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ইতিমধ্যে কাটা হয়ে গেছে। বাজারে নতুন পাট উঠতে শুরু করেছে। দেশের বিভিন্ন হাটবাজারে বর্তমানে প্রতিমণ পাট বিক্রি হচ্ছে মান ভেদে দুই হাজার থেকে দুই হাজার ৪ শ’ টাকা দরে। গত বছর এ সময়ে প্রতিমণ পাট বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার ৮শ’ থেকে ২ হাজার টাকা মণ দরে। ফলে কৃষকের মনের অজানা আতঙ্কের মেঘ কিছুটা হলে কাটতে শুরু করেছে।
বৈরি আবহাওয়া ও অসময়ে বৃষ্টিপাতের কারণে পাটের ফলন তেমন ভালো হয়নি। বেশি বৃষ্টিতে পাট গাছের গোড়ায় শিকড় গজায়। ফলে উচ্চতা কমে যাওয়ায় ফলনও কম হয়েছে। প্রচুর মৌসুমী বৃষ্টিপাতের কারণে পাট জাগ দেয়া নিয়ে কৃষকের কোনো দুঃচিন্তার অবকাশ নেই এবার। ক্ষেতের আশপাশে নদী-নালা, খাল-বিল ও ডোবায় পাট জাগ দিতে পেরে কৃষক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। এ বছর বিঘা প্রতি পাট ফলেছে ৮ থেকে ১০ মণ। আর উৎপাদন খরচ হয়েছে বিঘা প্রতি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। দুই হাজার টাকা মণ হিসেবে ৮ মণ পাটের দাম ১৬ হাজার টাকা। এতে বিঘা প্রতি পাট থেকে লাভ হবে ৬ হাজার টাকা। প্রতি বিঘা জমির পাটখড়ি বিক্রি করে কৃষকের আয় হয় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে এক বিঘা জমিতে পাট চাষ করে কৃষকের নিট লাভ হচ্ছে এবার ১০ হাজার টাকা,যা ধান চাষের চেয়ে অনেক বেশি।
পাট একটি পরিবেশবান্ধব ফসল। একই জমিতে বার বার ধান চাষ করলে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যায়। পোকামাকড় ও রোগরালাইয়ের আক্রমণ বেড়ে যায়। অন্যদিকে বোরো ও আমন ধানের মধ্যবর্তী সময়ে পাট চাষ করলে পাটের পাতা ও শিকড়ের অবশিষ্টাংশ পচে মাটিতে মিশে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পাট ফসল উৎপাদন কালে হেক্টর প্রতি পাঁচ থেকে ছয় টন পাতা মাটিতে পড়ে পচে জৈব সারে পরিণত হয়। পাটের পচনশীল ব্যাগ পলিথিনের জলবদ্ধতার অভিশাপ থেকে দেশকে রক্ষা করে। গ্রামের বহু মানুষ এখনও তাঁদের রান্না-বাড়ার কাজে পাট খড়ি ব্যবহার করেন। পাটের চাষ না হলে জ্বালানির জন্য গাছপালা কাটার পরিমাণ বেড়ে যাবে। এতে পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের মারাত্মক ক্ষতি হবে।
জিডিপেতে পাটের অবদান দশমিক ২৬ শতাংশ হলেও কৃষি খাতে এর অবদান ১ দশমিক ১৪ শতাংশ। দেশে মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা ৩ থেকে ৪ ভাগ আসে পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে। বাংলাদেশ মোট পাটের ৩৩ শতাংশ উৎপাদন করে এবং কাঁচা পাটের ৯০ শতাংশ রপ্তানি করে। দেশে পাট চাষির সংখ্যা ৪০ লাখ। পাট চাষ, পাট শিল্প, পাট পরিবহন ও পাট ব্যবসাসহ বিভিন্ন কাজে প্রায় ৪ কোটি মানুষের জীবনজীবিকা জড়িত। প্রতিবছর দেশের কৃষকেরা পাট বিক্রি করে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আয় করেন, যা গ্রামীণ অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সহায়তা করে। বাংলাদেশ বিশ্বে পাট উৎপাদনে দ্বিতীয় এবং রফতানিতে প্রথম। দেশে উৎপাদিত পাটের ৫১ শতাংশ স্থানীয় পাট কলে ব্যবহৃত হয়। ৪৪ শতাংশ কাঁচা পাট বিদেশে রফতানি হয়। আর মাত্র ৫ ভাগ দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের কাজে লাগে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুসারে, সদ্য সমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার আয় করে, যা ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের চেয়ে ১০ শতাংশ এবং লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭ শতাংশ বেশি। ওই একই অর্থ বছরে পাট সুতা রপ্তানি থেকে ৫৬ কোটি ৪৬ লাখ ডলার আয় হয়। মোট পাট রপ্তানির ৬৪ শতাংশ আসে পাট সুতা থেকে। কাঁচা পাট রপ্তানি থেকে আয় হয় ১৩ কোটি ডলার এবং পাটের বস্তা, চট ও থলে রপ্তানি করে আয় হয় ১০ কোটি ৬৫ লাখ ডলার।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত বছর দেশে ৬৮ লাখ বেল পাট উৎপন্ন হয়। চলতি মৌসুমে ৮২ লাখ বেল পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। দেশে মোট সাত লাখ ২৬ হাজার ৪৯৪ হেক্টর জমিতে এবার পাটের আবাদ হয়েছে, যা থেকে গত বছরের চেয়ে বেশি পরিমাণ পাট উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে।
পাট এমন একটি ফসল যার কোনো কিছুই ফেলনা নয়। পাটের আঁশ থেকে তৈরি হয় বহুবিধ পণ্য। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে শাড়ি, লুঙ্গি, কামিজ, সালোয়ার, পাঞ্জাবী, ফতুয়া, ব্যাগ, শোপিস সোনালী ব্যাগ, ওয়ালমেট, আলপনা, দৃশ্যাবলি, নকশিকাঁথা, পাপোশ, জুতা, স্যান্ডেল, ঢেউটিন, শিকা, দড়ি, সুতলি ও গহনাসহ ২৮৫ ধরনের পণ্য , যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। পৃথিবীর জনপ্রিয় গাড়ির ব্র্যান্ড মার্সিডিজ, ফোর্ড, টয়োটা, মিৎসুবিসি পাটের তন্তু ব্যবহার করে গাড়ির ভেতরের সাজসজ্জার উপকরণ তৈরি করছে- এটা আমাদের জন্য কম গৌরবের বিষয় নয়। পাটের তৈরি জিও টেক্সটাইল ব্যাগ ব্যবহার হচ্ছে নদী ভাঙ্গন রোধ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণে। পাটের আঁশ থেকে তৈরি করা হয় ভিসকস সুতা। ভিসকস সুতার তৈরি পোশাক অনেক আরামদায়ক এবং দামও বেশি। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট পাট থেকে গ্রিনটি আবিস্কার করে। তারই ধারবাহিকতায় জামালপুরের সরিষাবাড়িতে এক কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে পাট পাতা থেকে চা তৈরির একটি কারখানা নির্মাণ করা হয়েছে। জার্মানিতে এই চায়ের বেশ কদর রয়েছে। কারখান থেকে উৎপাদিত চা অতি শিগগিরই বিদেশে রপ্তানি হবে। তখন কৃষক চায়ের পাতার মতো পাট পাতাও উচ্চ মূল্যে বিক্রি করতে পারবেন। পাট থেকে উৎপাদিত সোনালী ব্যাগের দেশে বিদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সোনলী ব্যাগ পরিবেশ বান্ধব। প্রচলিত পলিথিন ব্যাগের চেয়ে দেড়গুণ শক্তিশালী। পচনশীল ও পুনরায় ব্যবহারযোগ্য। এতে প্লাস্টিকের কোনো উপাদান নেই।
এখন পাটখড়ি থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি হচ্ছে উচ্চ মূল্যের চারকোল। এই চারকোল বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে, যা থেকে তৈরি হচ্ছে কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপির কালি, মোবাইল ফোনের ব্যাটারি, ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্লান্ট, ও বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী পণ্য। পাটখড়ি থেকে উৎপন্ন চারকোল রপ্তানি হচ্ছে চীন, তাইওয়ান, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশে। চারকোলের বড় বাজার রয়েছে মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানিসহ ইউরোপীয় দেশগুলিতে। এখাত থেকে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে ১৫০ কোটি টাকা। দেশে চারকোল শিল্পের যাত্রা শুরু হয় ২০১২ সালে। বর্তমানে দেশের ছোটবড় মিলিয়ে ৪০টির মতো চারকোল তৈরির কারখানা রয়েছে। প্রতিটন চারকোল বাংলাদেশী মুদ্রায় ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। পাট ও পাটখড়ি মিলিয়ে পাট এখন কৃষকের কাছে লাভ জনক ফসল হয়ে দাড়িয়েছে। পাটের বর্তমান বাজার দর ও বিভিন্ন মিলের চাহিদা থাকায় চাষির পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও লাভবান হচ্ছেন।
পরিবেশ দূষণের কম বেশি শিকার হচ্ছে সারা বিশ্ব। দেশে দেশে প্রাকৃতিক তন্ত্র ব্যবহারের আইন হচ্ছে। সবাই পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহারের দিকে নজর দিচ্ছে। চলতি বছর থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত জোটের ২৮ দেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ আইন কার্যকর হচ্ছে। এই জোটে বর্তমানে ৪৫ বিলিয়ন শপিং ব্যাগের ব্যবহার হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপানসহ অনেক দেশ প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহার উৎসাহিত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক জুট স্টার্ডি গ্রুপের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ব বাজারে শুধু শপিং ব্যাগের বার্ষিক চাহিদা ৫০০ বিলিয়ন পিস। বিজনেস ওয়ারের প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২২ সালে হোম গার্ডেনিং ও ভার্টিক্যাল গার্ডেনিং-এর বাজার হবে ৩৩২ বিলিয়ন ডলার। ফ্যাশন , লাইফ স্টাইল ও অ্যাপারেল বাজার হবে ২ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এ সব খাতে পাটের বহুমুখী ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এ দিকে নজর দিলে বাংলাদেশ বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে সক্ষম হবে।
২০১৮ সালে সরকার পাটজাত পণ্যের বাধ্যতামূলক ব্যবহার বিধিমালা, ২০১৩ অধিকতর সংশোধন করে হাঁস-মুরগি ও মাছের খাবার সংরক্ষণ এবং পরিবহনে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করায় হলুদ, মরিচ, আদা, রসুন, সার, চিনি, আলু, আটা, ময়দা, ডালসহ মোট ১৯টি পণ্যের মোড়কে পাটের ব্যবহার বাধ্যতা মূলক করা হয়। আইন অনুযায়ী কেউ এসব পণ্যে পাটের মোড়ক ব্যবহার না করলে অনুর্ধ্ব এক বছর কারাদন্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। দ্বিতীয় বার কেউ একই অপরাধ করলে সে দ্বিগুণ দন্ডে দন্ডিত হবেন। আশা করা যায়, এই আইন বাস্তবায়িত হলে প্রতিবছর ১০০ কোটির বেশি পাটের বস্তার চাহিদা সৃষ্টি হবে। স্থানীয় বাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। পাট চাষিদের পাটের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। সর্বোপরি পাটের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। দেশের সম্ভাবনাময় কৃষি ভিত্তিক পাট শিল্প ও পরিবেশ রক্ষা পাবে। তাই সোনালী আঁশের এই বিপুল সম্ভাবনাকে আমাদের অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে।