নিতাই চন্দ্র রায় /
দেশের চাষ করা পাটের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কাটা হয়ে গেছে। সরকারি পাটকলগুলো বন্ধের পর পণ্যটির ন্যায্যমূল্য নিয়ে পাটচাষিদের মধ্যে এক অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছিল। সারা দেশের হাটবাজারগুলোতে বর্তমানে প্রতি মণ পাট বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা মণ দরে। এতে পাটচাষিদের মনের অজানা আতঙ্ক কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়েছে। গত বছর এ সময় প্রতি মণ পাট বিক্রি হয়েছে ২ হাজার টাকা মণ দরে।
মৌসুমের শুরুতেই প্রতি মণ পাট ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হওয়ায় বেসরকারি পাটকল মালিকদের মধ্যে পাটের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে এক ধরনের উদ্বেগ লক্ষ করা যায়। তাদের কথা বন্যা ও করোনার কারণে এ বছর পাটের উৎপাদন কম হবে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও এবার পাটের উৎপাদন কম হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যদি কাঁচা পাট রপ্তানি করা হয়, তাহলে উৎপাদিত পাটের একটি বিরাট অংশ ভারতে চলে যাবে এবং পাটের দাম আরও বৃদ্ধি পাবে। পাটের অভাবে দেশের পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। এসব যুক্তি দেখিয়ে তারা কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধ অথবা কাঁচা পাট রপ্তানির ওপর টনপ্রতি ২৫০ ডলার শুল্ক আরোপের দাবি জানিয়েছেন সরকারের কাছে। তাদের কথা বন্যাসহ নানা কারণে পাটের উৎপাদন ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কম হবে। তাতে পাটের উৎপাদন ৬৫ লাখ বেলের বেশি হবে না। গত বছর বেসরকারি পাটকলগুলোতে ৬০ লাখ বেল পাট ব্যবহার হয়েছে। পাটের উৎপাদন যেটুকু হয়েছে, তা বেসরকারি পাটকলগুলোরই লাগবে। যুক্তি হিসেবে আরও বলা হয়েছে, প্রতি টন কাঁচা পাট ৮০০ থেকে ৯০০ ডলারে রপ্তানি করা হয়। অন্যদিকে প্রতি টন পাট সুতা রপ্তানি করা হয় ১ হাজার ৫০০ ডলার মূল্যে। এতে শতকরা ৪০ ভাগের বেশি মূল্য সংযোজন হয়। এ ছাড়া প্রতি টন কাঁচা পাট রপ্তানিতে চার থেকে পাঁচজনের কর্মসংস্থান হলেও প্রতি টন পাট সুতা রপ্তানিতে কর্মসংস্থান হয় ৮০ থেকে ৮৫ জন লোকের। তাই কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বিষয় বিবেচনা করে বিদেশে কাঁচা পাট রপ্তানির কোনো যুক্তি নেই। বেসরকারি পাটকল মালিকদের এসব কথার যুক্তি আছে ঠিকই। কিন্তু যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পাট উৎপাদন করেন, তারা যখন পণ্যটির ন্যায্যমূল্য পান না; উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন, তখন তাদের কাছে মূল্য সংযোজন, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বিষয়গুলো কোনো সুখবর বয়ে আনে না। আর সরকারও বিদেশে কাঁচা পাট রপ্তানি করতে চায় না। কিন্তু কৃষক যখন তাদের উৎপাদিত পাটের ন্যায্যমূল্য পান না, উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে পাট বিক্রি করতে বাধ্য হন, তখনই শুধু সরকার বিদেশে কাঁচা পাট রপ্তানির অনুমতি প্রদান করে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের বক্তব্য হলো ৮ থেকে ১০ লাখ বেলের বেশি কাঁচা পাট বিদেশে রপ্তানি হয় না। তাই কাঁচা পাট রপ্তানিতে দেশীয় শিল্পে সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই। গতবার রপ্তানির সুযোগ দেওয়ায় কৃষক ভালো দাম পেয়েছে পাটের। পরিকল্পনা কমিশনের একজন সদস্য ও প্রখ্যাত কৃষি অর্থনীতিবিদের কথা, রপ্তানি বন্ধ হলে কাঁচা পাটের দাম কমে যাবে। তাতে পাটকল মালিকরা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষক। তবে পাটচাষিদের ওপর শাস্তি আরোপ হোক এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। আমরা তার সঙ্গে সহমত পোষণ করি। ভয় হয়, শুল্ক আরোপের ফলে যদি বাংলাদেশ বিদেশে কাঁচা পাট রপ্তানির বাজার হারায়, তাহলে বেসরকারি পাটকল মালিকদের একচেটিয়া মুনাফার কারণে চামড়ার মতো হতে পারে দেশে কাঁচা পাটের বাজার। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। শুধু একপক্ষের স্বার্থ দেখলে চলবে না। পাটচাষি, পাট ব্যবসায়ী ও পাটকল মালিক সবার স্বার্থ দেখতে হবে।
পাটকল মালিক ও পাট ব্যবসায়ীদের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে কাঁচা পাট রপ্তানির ওপর শুল্ক আরোপের বিষয়ে গত ২৮ আগস্ট অনুষ্ঠিত জাতীয় পাট খাত সমন্বয় কমিটির ভার্চুয়াল সভায় কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। তবে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর কথা কাঁচা পাট রপ্তানির ওপর শুল্ক আরোপের বিষয়ে এমনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, যাতে পাটচাষি, কাঁচা পাট রপ্তানিকারক পাটকল মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত না হন। যতক্ষণ পর্যন্ত কাঁচা পাটের সবটুকু ব্যবহার করার সক্ষমতা বেসরকারি পাটকলের হবে না, ততক্ষণ রপ্তানি সুবিধা থাকা প্রয়োজন।
পাট অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৭ লাখ ৫২ হাজার একর জমিতে ৮৪ লাখ ৫৫ হাজার বেল পাট উৎপাদন হয়েছে। রপ্তানি হয়েছে সাড়ে আট লাখ বেল। আর চলতি অর্থবছরে ১৭ লাখ ৬৪ হাজার একর জমিতে ৮৪ লাখ ১৪ হাজার বেল পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। প্রতি মণ পাট উৎপাদনে এবার খরচ হয়েছে ১ হাজার ৮৫৭ টাকা। বর্তমানে যে দামে পাট বিক্রি হচ্ছে, সেটি বেশি নয়। তার চেয়ে কম দামে বিক্রি হলে পাটচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, চলতি মৌসুমে ৮২ লাখ বেল পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। ৭ লাখ ২৬ হাজার হেক্টর জমিতে এবার পাটের আবাদ হয়েছে। সরকারি পাটকলগুলো প্রতি বছর গড়ে ১৩ লাখ বেল পাট কিনে থাকে। এবার ওই ১৩ লাখ বেল পাট সরকারি পাটকলগুলোর কেনার কোনো সম্ভাবনা নেই। উৎপাদিত পাটের ৫০ থেকে ৫৫ লাখ বেল ব্যবহার হয় বেসরকারি পাটকলগুলোতে। স্থানীয় কাজার থেকে ফড়িয়া এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সারা বছরের পাট সংগ্রহ করে বেসরকারি পাটকলগুলো। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সূত্রে জানা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ২০ লাখ বেল কাঁচা পাট রপ্তানি হতো। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে আট থেকে নয় লাখ বেলে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কাঁচা পাট রপ্তানি হয় আট লাখ বেল। সদ্য সমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা আরও কমে দাঁড়ায় ৬ লাখ ১৪ হাজার বেলে। তাই কাঁচা পাট রপ্তানি হলে বেসরকারি মিলগুলো কাঁচা মালের সংকটে পড়বে এবং প্রতি টন কাঁচা পাট রপ্তানিতে ২৫০ ডলার শুল্ক আরোপ করতে হবে বেসরকারি পাটকল মালিকদের এ দাবি বোধগম্য নয়। যদি কৃষক পাট চাষ করে লাভবান হন; ন্যায্যমূল্য পান, তাহলে দেশে কাঁচা পাটের অভাব হবে না। কারণ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ দেশের কৃষকরাই ৮ লাখ ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষ করে ৯২ লাখ বেল পাট উৎপাদন করে স্বাধীনতার পর সর্বোচ্চ রেকর্ড স্থাপন করেন।
বেসরকারি পাটকল মালিকরা পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সক্ষম হলে দেশে পাটের আবাদ এবং হেক্টরপ্রতি উৎপাদন বাড়বে। বোরো ও আমন ধানের মধ্যবর্তী সময়ে পাট উৎপাদন করে কৃষক লাভবান হবেন। পাট চাষে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পাবে এবং পরিবেশ থাকবে নিরাপদ। আমরা চাই বেসরকারি পাটকলগুলো তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী পাটপণ্য উৎপাদন করুক। কাঁচা পাটের অভাবে দেশের পাটকলগুলো বন্ধ থাকুক এটা কারও কাম্য নয়। আবার কাঁচা পাট রপ্তানির অভাবে
কৃষক পাটের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হোক, পানির দামে পাট বিক্রি করে কৃষক সর্বস্বান্ত হোক এটাও দেশবাসী প্রত্যাশা করে না। তাই বিদ্যমান অবস্থায় কাঁচা পাট রপ্তানির ওপর শুল্ক আরোপ কোনো অবস্থাতেই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। এ মুহূর্তে কাঁচা পাট রপ্তানির ওপর শুল্কারোপ হবে একটি আত্মঘাতী ও কৃষক স্বার্থের পরিপন্থী সিদ্ধান্ত।
একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, গত বছর দেশে ৮৪ লাখ বেল পাট উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত পাট থেকে বেসরকারি পাটকলগুলো ৬০ লাখ বেল, সরকারি পাটকলগুলো ১২ লাখ বেল এবং কাঁচা পাট হিসেবে বিদেশে রপ্তানি হয় আট লাখ বেল। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের মাঠ পরিদর্শনের আলোকে যে আভাস পাওয়া যায়, তাতে গতবারের চেয়ে এবার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পাটের উৎপাদন কম হতে পারে। গত বছর ৮৪ লাখ বেল পাট উৎপাদিত হলে এ বছর বন্যার কারণে গতবারের চেয়ে ১৫ শতাংশ কম উৎপাদন হওয়ার পরও দেশে পাট উৎপাদন হওয়ার কথা ৭১ দশমিক ৪ লাখ বেল। সে হিসেবে বেসরকারি পাটকলগুলোর কাঁচা পাটের সংকট হওয়ার কোনো কারণ থাকার কথা নয়।
আমাদের কথা, এ বছর কী পরিমাণ পাট উৎপাদিত হবে? সরকারি বন্ধ পাটকলগুলোর গুদামে কী পরিমাণ পাট মজুদ আছে? সে পাটের কী হবে? বেসরকারি পাটকলগুলোর সক্ষমতা কত? এই বিষয়গুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধ বা শুল্ক আরোপের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। দেশে উৎপাদিত পাট থেকে বেসরকারি পাটকলগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচা পাট রেখে অবশিষ্ট কাঁচা পাট বিদেশে রপ্তানি করাটাই সমুচিত। আবার হঠাৎ করে কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশ বিদেশে কাঁচা পাট রপ্তানির বাজার হারাতে পারে, যা দেশের পাটচাষিদের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে কাঁচা পাট রপ্তানির কোটা নির্ধারণ করা যেতে পারে। এ বছর দেশে কী পরিমাণ পাট উৎপাদিত হতে পারে সে ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয় তথা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
লেখক সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড