নিজস্ব প্রতিবেদক: দৈনিক যুগান্তরের সিনিয়র রিপোর্টার মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নুর মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা দায়েরের পর ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে তদন্তে নেমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা চমকপ্রদ তথ্য পাচ্ছেন। জানতে পেরেছেন তার বিপুল সম্পদ ও তার স্ত্রীর রেখে যাওয়া জীবনের কাহিনী। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কারা, কীভাবে জড়িত সে ব্যাপারে আরো তথ্যানুসন্ধান করছে পুলিশ।
নান্নুর রহস্যঘেরা মৃত্যুর পর পুলিশের গুলশান বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ পৃথক পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করে। তারা সমন্বয় করে কাজ করছেন। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ও সিআইডি ফরেনসিক আলামত সংগ্রহ করেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা এ পর্যন্ত প্রাপ্ততথ্যে নান্নুর
মৃত্যু দুর্ঘটনাজনিত নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে জানতে পেরেছেন। সেইসঙ্গে হত্যাকাণ্ডের কারণ সম্পর্কেও তারা বেশ কিছু তথ্য পেয়েছেন। বাবা-পুত্রের মৃত্যুর সঙ্গে মিলেছে যোগসূত্র। শিগগিরই তদন্ত কমিটিগুলো তাদের প্রতিবেদন দাখিল করবে বলে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে হত্যারহস্য উদ্ঘাটনে ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে লাশ তোলা হবে। হত্যা মামলার বাদী নান্নুর বড় ভাই নজরুল ইসলাম খোকন লাশ উত্তোলনের জন্য তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করেছেন। তদন্তের প্রয়োজনে নান্নুর পুত্র পিয়াসের লাশও কবর থেকে উত্তোলন করা হতে পারে বলে জানা গেছে। তবে এখনো আটক হয়নি নান্নুর স্ত্রী, শাশুড়ি ও পল্লবীর কথিত কর্মস্থলের (ইনফিনিটি লি.) সিইও সিরাজুল আমিন রুমেল। তাদের ধরতে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে। বাড্ডা থানা থেকে যশোর পুলিশকে এ ব্যাপারে অবগত করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) আব্দুর রাজ্জাক বলেন, লাশ উত্তোলনসহ সার্বিক কার্যক্রম চলছে। সিনিয়র অফিসাররা এ নিয়ে কাজ করছেন। একাধিক টিম মাঠে রয়েছে। তবে আসামি আটক ও বিস্তারিত তদন্তের স্বার্থে তিনি এর বেশি কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
পুলিশের তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত। তার স্ত্রী শাহিনা হোসেন পল্লবীর কথিত কর্মস্থলের কর্ণধার সিরাজুল আমিন রুমেল আদম ব্যবসায় (জনশক্তি রপ্তানি) জড়িত। তিনি লিবিয়ায় মানবপাচারে জড়িত বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে। বাড্ডা শাহাজাদপুর এলাকায় তার অফিস রয়েছে। তার অনেক অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নান্নু দম্পতির নাম। নান্নুকে হাসপাতালে নেয়ার পর সবাইকে আড়াল করে সবকিছু তদারকি করেন রুমেল। এমনকি লাশ ময়নাতদন্ত না করে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে যশোরে নিয়ে দাফনের তদারকিও করেন তিনি। নান্নুর স্বজন ও সহকর্মীদের ছাপিয়ে তার তৎপরতায় শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। গুঞ্জন রয়েছে, রুমেলের দেহরক্ষীর সঙ্গেও পল্লবীর সখ্য ছিল। তারও যাতায়াত ছিল পল্লবীর ফ্ল্যাটে। নান্নু অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পরদিন সকালে রুমেলের কালো রংয়ের পাজেরো গাড়িটি ছিল আফতাবনগরের ফ্ল্যাটের নিচে।
কতদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নান্নু ও তার স্ত্রীর নামে ঢাকা ও যশোরে বিপুল সম্পদ রয়েছে। আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিবিহীন সম্পদ অর্জনে নান্নু ও তার স্ত্রী একযোগে কাজ করতেন। বেশির ভাগ লেনদেনের সঙ্গে তার স্ত্রী জড়িত ছিলেন। তার স্ত্রী কারওয়ান বাজারসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকা দিন-রাত চষে বেড়াতেন। মোহাম্মদপুর এলাকায়ও তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। নিয়মিত মদ্যপান করতেন। তাদের ফ্ল্যাটেও পার্টি হতো। পল্লবীর নিম্নবৃত্ত পরিবারে জন্ম নিলেও বিয়ের পর ঢাকায় তার জীবনযাপন ছিল বেপরোয়া। পুলিশসহ সমাজের অনেক প্রভাবশালীর সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।
অনেকের সঙ্গে তার সম্পর্কে গড়ে ওঠায় নান্নু হয়ে পড়েছিলেন অসহায়। একপর্যায়ে নান্নু সবকিছু স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়। মায়ের বেপরোয়া আচরণে একমাত্র ছেলে বিমর্ষ হয়ে পড়েন। যার অনেক কিছু তিনি (স্বপ্নীল আহমেদ পিয়াস) মেনে নিতে পারছিলেন না। এ নিয়ে প্রায়ই বাসায় কলহ হতো।
উল্লেখ্য, গত ১১ জুন মধ্য রাতে নান্নু তার আফতাবনগরের ফ্ল্যাটে রহস্যজনকভাবে অগ্নিদগ্ধ হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৩ জুন সকালে তার মৃত্যু হয়। এরপর তড়িঘড়ি করে তার লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই যশোরে তার শ^শুর বাড়িতে নিয়ে দাফন করা হয়। এর আগে গত ২ জানুয়ারি একই ফ্ল্যাটে নান্নু-পল্লবী দম্পতির একমাত্র সন্তান স্বপ্নীল আহমেদ একইভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেলে তার লাশও তড়িঘড়ি করে দাফন করা হয়। তার মৃত্যু রহস্যঘেরা।
গত সোমবার নান্নুর বড় ভাই নজরুল ইসলাম খোকন বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় হত্যা মামলা দাায়ের করেন। নান্নু হত্যা মামলার সঙ্গে এখন স্বপ্নীলের মৃত্যু আসলে কীভাবে হয়েছে তার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। মামলায় নান্নুর স্ত্রী শাহিনা হোসেন পল্লবী, তার মা শান্তা পারভেজ ও পল্লবীর কথিত কর্মস্থলের সিইওকে আসামি করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর পর নান্নু তার সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে বৃদ্ধাশ্রম, এতিমখানা ও ট্রাস্ট করার চিন্তা করছিলেন। এ নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে তার বনিবনা হচ্ছিল না। মূলত বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি কবজা করতেই এ হত্যাকাণ্ড বলে মনে করছে পুলিশ।