খরা-বন্যা, নদীভাঙন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে যুগ যুগ ধরে যুদ্ধ করেই বেঁচে আছে বাংলাদেশের সাহসী মানুষ। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এর ওপর দিয়ে অসংখ্য নদী প্রবাহিত হয়ে গিয়ে পড়েছে বঙ্গোপসাগরে। বাংলাদেশের অবস্থান গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলে হওয়ায় এবং দেশটির ওপর দিয়ে প্রবাহিত বিভিন্ন নদী ও উপনদীর কারণে প্রতিবছরই এখানে ছোট থেকে মাঝারি আকারের বন্যা হয়। সাধারণত জুন থেকে সেপ্টম্বর পর্যন্ত থাকে বন্যার বিস্তৃতি। বন্যার স্থায়িত্বের ওপর ক্ষয়ক্ষতি ও মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নির্ভর করে। দেখা গেছে, প্রতি ১০ বছর পরপর বাংলাদেশে বড় বন্যা হয়। ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৮ ও ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ভয়াবহ বন্যায় প্লাবিত হয়। ১৯৮৮ সালের বন্যা ছিল বাংলাদেশে সংঘটিত প্রলয়ঙ্করী বন্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে সংঘটিত বন্যায় দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা ডুবে যায়। স্থানভেদে ওই বন্যা ১৫ থেকে ২০ দিন স্থায়ী হয়। সর্বনাশী বন্যায় প্রায় ৮২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়। অসংখ্য ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট বিনষ্ট হযে যায়। অনেক মানুষ এবং গৃহপালিত পশুপাখি প্রাণ হারায়।
এবারের বন্যা অন্য বছরের বন্যার চেয়ে একটু ভিন্ন প্রকৃতির। করোনা মহামারি চলাবস্থায় আম্পান-উত্তর এই বন্যা যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশে। দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। দেশের কৃষক, মৎস্য চাষি, পোলট্রি ও দুগ্ধ চাষিরা করোনা ও আম্পানের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে যখন হিমশিম খাচ্ছেন, পানির দামে উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিক্রি করে যখন সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন, মহাজনের ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছেন, তখন বন্যার মতো দুর্যোগ এসে কৃষক, মৎস্য চাষি, দুগ্ধ এবং পোলট্রি খামারিদের ফেলেছে মহাবিপদে।
এবারের তিন দফা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৪৮ হেক্টর জমির ফসল। এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ১ লাখ ৫৮ হাজার ৮১৪ হেক্টর। সব মিলিয়ে ৩৭ জেলয় তিন দফা বন্যায় ফসলের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ১২ লাখ ৭২ হাজার ১৫১ জন। এই সব ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে প্রণোদনার আওতায় আনার ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বন্যার এ ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত পরিসংখ্যান তুলে ধরেন।
এবারে বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আউশ ধান। উপদ্রুত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত আউশ ধানের জমির পরিমাণ ৩২ হাজার ২১৩ হেক্টর এবং টাকার অঙ্কে ৩৩৪ কোটি। এছাড়া ৭০ হাজার ৮২০ হেক্টর জমির ৩৮০ কোটি টাকা মূল্যের আমন ধান ও ৭ হাজার ৯১৮ হেক্টর জমির আমন বীজতলা বন্যায় ক্ষতির শিকার হয়েছে। এর বাইরে ২৩৫ কোটি টাকার সবজি ও ২১১ কোটি টাকার পাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন চিনিকল এলাকায় আখ ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বন্যায়।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক যাতে ক্ষতি পুষিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারেন, সেজন্য ব্যাপক প্রণোদনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। এরই মধ্যে ২ লাখ ৩৯ হাজার ৬৩১ জন ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মধ্যে ১৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকার কৃষি উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে। এর আওতায় স্বল্পমেয়াদি বিভিন্ন শাকসবজি চাষের জন্য প্রায় ১০ কোটি ২৭ টাকা ব্যয়ে ১ লাখ ৫২ হাজার কৃষককে লালশাক, ডাঁটাশাক, পালংশাক, বরবটি, শিম, শসা, লাউ ইত্যাদির বীজ বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যদি আমন চাষ সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে ৩৫ জেলায় ৫০ হাজার কৃষকের মধ্যে প্রায় ৩ কোটি ৮২ লাখ টাকার মাষকলাইয়ের বীজ, ডিএপি ও এমওপি সার বিনামূল্যে বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আরও প্রায় ৭৫ কোটি টাকার সরকারি প্রণোদনা কর্মসূচি প্রক্রিয়াধীন আছে। এই অর্থ দিয়ে ৯ লাখ ২৯ হাজার ১৯৫ জন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে গম, শরিসা, চীনাবাদাম, সূর্যমুখী, খেসারি, পেঁয়াজ, মরিচ, টমেটো ইত্যাদি ফসল চাষের জন্য বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ সরবরাহ করা হবে। সবজি পুষ্টি বাগান স্থাপন কর্মসূচির আওতায় এখন পর্যন্ত ৬৪ জেলায় ৩৭ কোটি ৩৬ লাখ ২২ হাজার টাকা ব্যয়ে মোট ১ লাখ ৪১ হাজার ৭৯২ জন কৃষকের মধ্যে বিনামূল্যে বীজ, চারা ও সার সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ২০২০-২১ বছরে মুজিববর্ষ উপলক্ষে পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপনে কৃষি প্রণোদনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় ১৫২ কোটি ৯১ লাখ টাকা ব্যয়ে ৬৪ জেলায় ৪৯১টি উপজেলায় মোট ৪ লাখ ৭৩২ হাজার ৭০০ জন কৃষকের মধ্যে বিনামূল্যে বীজ, চারা ও সার সহায়তা প্রদান করা হবে।
সংক্রামক রোগ-ব্যাধি থেকে মানুকে বাঁচাতে হলে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নলকূপ ও ল্যাট্রিনগুলো জরুরিভিত্তিতে মেরামতের ব্যবস্থা করতে হবে। মেরামত করতে হবে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বন্যায় অনেক কৃষকের পাওয়ার টিলার, অগভীর নলকূপসহ বিনষ্ট হয়ে গেছে বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি। এসব কৃষি যন্ত্রপাতি জরুরিভিত্তিতে মেরামতের উদ্যোগ নিতে হবে। বন্যার ফলে অধিকাংশ কৃষক অভাবে পড়ে গৃহপালিত পশুপাখি বিক্রি করে দিয়েছেন। তাদের বিনামূল্যে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগলের বাচ্চা ও খাবার সরবরাহ করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে গৃহপালিত পশুপাখির চিকিৎসা, টিকা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ। বন্যার পরপরই কৃষককে দানাশস্যের অভাব পূরণের জন্য ভুট্টা, সরিষা, মাষকলাই ও মুগ ডাল চাষের ওপর জোর দিতে হবে।
বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত আলোক-সংবেদনশীল উফশী জাত বিআর ৫, বিআর ২২, বিআর ২৩, ব্রিধান ৩৪, ব্রিধান ৪৬ এবং নাইজারশাইলসহ স্থানীয় জাতগুলো রোপণ করতে হবে। এক্ষেতে আগস্ট পর্যন্ত বীজতলা করা যাবে। দেশের উত্তরাঞ্চলে আগাম শীত আসার কারণে ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এবং দক্ষিণাঞ্চলে ২০ সেপ্টেম্বরের পর আমন ধান রোপণ করা উচিত নয়। সেক্ষেত্রে আগাম রবি ফসলের চাষ করতে হবে। যেসব এলাকা ফের বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম সেসব উঁচু ও মধ্যম উঁচু জমিতে সরাসরি অঙ্কুরিত আমন ধানের বীজ ছিটিয়ে বপন করতে হবে। বন্যার ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া ধান গাছের যাবতীয় পরিচর্যা যেমন আগাছা দমন, পোকামাকাড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষা, সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ এবং সম্পূরক সেচ প্রদানের কাজগুলো যথা সময়ে যত্নের সঙ্গে সম্পাদন করতে হবে।
বন্যা উপদ্রুত এলাকার কৃষক ভাইদের প্রণোদনার আওতায় শতকরা ৪ ভাগ সুদে কৃষি ঋণ প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনে প্রতিটি গ্রামে ঋণ বিতরণের জন্য ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে ক্যাম্প খুলতে হবে। বন্যায় সর্বস্বান্ত কৃষকের হাতে কোনো নগদ অর্থ নেই। মাঠে নেই বিক্রির মতো কোনো ফসল। তাই কৃষকের কাছ থেকে সব ধরনের ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তি আদায় আগামী তিন মাস পর্যন্ত সম্পূর্ণ বন্ধ রাখতে হবে। বন্যা উপদ্রুত এলাকায় পশুখাদ্যের তীব্র অভাব দেখা দেয়। বন্যা হয়নি এমন এলাকা থেকে পশুখাদ্য এনে বন্যা উপদ্রুত এলাকার খামারিদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করতে হবে।
এবারের বন্যায় বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ফসলি জমির পাশাপাশি মাছের ঘের ও পুকুরের বড় ক্ষতি হয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, এবারে বন্যায় ৩৮২ কোটি টাকার মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য চাষির সংখ্যা ৪৭ হাজার ৬৬২ জন। এছাড়া ১৩ হাজার ২০১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের জলাভূমির মাছ ভেসে গেছে বন্যায়। বন্যায় সবচেয়ে বেশি মাছের ক্ষতি হয়েছে সুনামগঞ্জ জেলায়। সেখানে ৫২ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। এর আগে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে সাতক্ষীরা ও যশোর এলাকার পুকুর ও ঘেরের বিপুর পরিমাণ মাছ ভেসে যায়। দেশের ধান, পাট ও সবজি চাষিদের ক্ষতি পোষাতে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও মাছ চাষিদের পুনর্বাসনে এখন পর্যন্ত তেমন উদ্যোগ দৃশ্যমান হচ্ছে না। কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতো মাছ চাষিদেরও পুনর্বাসনে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন ক্ষতিগ্রস্ত পোলট্রি চাষিদেরও পুনর্বাসন করা। বন্যা উপদ্রুত এলাকার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি, ক্ষেতমজুর, মৎস্য চাষিদের আগামী তিন মাস ভিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে খাদ্য সহায়তা প্রদান করতে হবে।
বন্যার ফলে পলি মাটি পড়ে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায়। মাটিতে বসবাসকারী পোকামাকড়ের উপদ্রব হ্রাস পায়। ফসল ক্ষেতের রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ অপসারিত হয়। মুমূর্ষু মাটি আবার নতুন জীবন ফিরে পায়। এ কারণে বন্যার পর ফসলের বাম্পার ফলন হয়। আমাদের এ সুযোগটার ষোলআনা কাজে লাগাতে হবে।
করোনা ঝুঁকির সময় কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বিএডিসি এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে হাওরাঞ্চলসহ সারা দেশের কৃষক সময় মতো নির্বিঘ্নে বোরো ধান কেটে ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। বন্যা-উত্তর কৃষি পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার ঠিক একইভাবে সবাই সক্রিয় হলে বন্যা বিধ্বস্ত মৃত মাঠ আবার ভরে উঠবে সোনালি ফসলে এবং কৃষকের মুখেও ফুটবে পরিতৃপ্তির হাসি।
নিতাই চন্দ্র রায়
সাবেক মহাব্যবস্থাক (কৃষি)
নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস্ লি:
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন