ক্রীতদাসেরাও কি হাসে? নাকি শ্রমক্লিষ্ট শরীর থেকে নিংড়ানো ঘাম হয়ে মাটিতে পড়ে শুকিয়ে যায়? ওদেরও কি ভালোলাগা ও ভালোবাসার তীব্র সুখের অনুভূতি জ্যোৎ্স্নার প্লাবনে ভেসে বেড়ায়? ওরা কি স্বাধীন জীবনের বাঁধভাঙা উল্লাস বুকে নিয়ে মুক্ত আকাশের নিচে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে? -এতোসব প্রশ্নের জবাব মেলা সত্যিই বড় কঠিন! আপনারা হয়তো শুনেছেন, ‘ক্রীতদাসের হাসি’ নামের একটি উপন্যাসের কথা। বাংলাদেশের অন্যতম কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান ১৯৬২ সালে লিখেছিলেন ওই উপন্যাসটি। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে বাক-স্বাধীনতা হরণ করা হয়। সেই শাসন ব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করে উপন্যাসটি রচিত। উপন্যাসের মূল চরিত্র তাতারী। গণতান্ত্রিক চেতনাকে দমন করার জন্যই সামরিক শাসন। কিন্তু রূপকের মধ্য দিয়ে তীব্র হয়ে ওঠে লেখকের প্রতিবাদ। সোচ্চার হয় ‘ক্রীতদাসের হাসি’র তাতারী। খলিফা হারুনর রশীদ কোনো কিছুর বিনিময়েই তাতারীর হাসি শুনতে পান না। খলিফার নির্দেশে হাসার চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করেছে তাতারী। খলিফা হারুনর রশীদের একটি বাগদাদ কাহিনীকে শওকত ওসমান ষাটের দশকের পাকিস্তানি সামরিক শাসনের প্রেক্ষাপটে একে তাচ্ছিল্য করার জন্য পুনর্নির্মাণ করেছেন। সামরিক শাসনে ব্যক্তির আত্মার মৃত্যু ঘটে। বুদ্ধিজীবীরা তাদের প্রতিশ্রুত সততা পাশ কাটিয়ে আত্মার মৃত্যু উপভোগ করেছেন, কেউ কেউ হয়ে উঠেছেন সমর শাসনের দোসর। বীরসৈনিকরা শেষ পর্যন্ত তাদের মাতৃভূমি জয় করেছে। ঠাট্টা শওকত ওসমান করেছেন, হাতে চাবুক নিয়ে। ক্ষমতার দুর্লঙ্ঘ প্রভাব মানুষকে দুর্বিনীত করে তোলে। তিনি সরল স্বীকারোক্তি করেছেন জল্লাদ মশরুরের কাছে : ‘মশরুর খেলাফত তো পাওনি, বুঝবে না রাজত্বের লোভ কত। এই লোভের আগুনের কাছে হাবিয়া দোজখ সামাদানের ঝিলিক মাত্র। বিবেক, ক্ষমতা, মনুষ্যত্ব- সব পুড়ে যায় সেই আগুনে।’ গোলাম তাতারী খলিফার স্ত্রী বেগম জুবায়দার বাঁদির প্রেমে মগ্ন। নিজের নৈঃসঙ্গের হাহাকার আড়াল করে বেগম মেহেরজান ও তাতারীর ভালোবাসার পথ সুগম করে দেন। নিত্যকার রাতের সফরে তাতারী ও মেহেরজানের প্রাণখোলা হাসির শব্দ তাকে উতলা করে তোলে। তিনি শোনেন: আবার সেই উতরোল হাসি ওঠে এই জীর্ণ গৃহের মধ্যে। ফিরদৌস তো দূরে নয়। বুকের কপাট খুললে যে হাওয়া বেরোয়, তারই স্নিগ্ধতা আর শীতলতা দিয়েই বেহেশত তৈরি। ভালোবাসার হাসি সহজে থামা জানে না।
‘ক্রীতদাসের হাসি’ প্রসঙ্গের এখানেই ইতি টানি। পেছনে ফিরে দেখি মানব সভ্যতার শুরুতে দাসপ্রথা প্রচলনের ইতিহাস। আমরা সবাই জানি গ্রিক সভ্যতার কথা। সেই গ্রিস দেশের মানুষেরা তৈরি করেছিল এক নতুন সভ্যতা। যা আগে কখনও ছিল না। কী চমৎকার চেহারা আর শরীর ওদের! দেখলেই ভালো লাগে, ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। ওদের কীর্তির কথাও বলে শেষ করা যাবে না। ছেনি আর হাতুড়ি দিয়ে কী অপরূপ মূর্তি তৈরি করেছিল, সেই যুগে। কবিতা পড়েও মগ্ন হয়ে যাবেন কোনও এক অনন্তলোকে। আর দর্শন-জ্ঞান-বিজ্ঞানে তো এখনও ওদের জুড়ি মেলা ভার। অছাড়া রাজনীতি, যুদ্ধের কৌশল, ব্যবসা-বাণিজ্য- কোনোকিছুতেই ওরা পিছিয়ে ছিল না। এখানে বলে রাখি, গ্রিক সভ্যতার সূচনা যিশুর জন্মের আনুমানিক দুহাজার বছর আগে মাইনোয়ান যুগে।
কিন্তু দেশটা সুজলা-সুফলা নয়, বরং কঠিন মাটি, পাথর, পাহাড়-উত্যকায় ভরা। বাঁচার জন্য যে খাবার প্রয়োজন, তা ওদের ছিল না। সামান্য খাদ্যের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হতো। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এতাসব কীর্তি গড়ার সময় পেলো কিভাবে? এখানেই ওদের জ্ঞানের নমুনা দেখা যায়। কাজের জন্য মানুষ কিনলো, যাদেরকে আমরা বলি, ক্রীতদাস। পরিশ্রমের কোনো কাজই গ্রিকরা নিজের কাছে না রেখে চাপিয়ে দিলো দাসদের ঘাড়ে। আর ওরা নিয়োজিত হলো সৃজনশীল কাজে। হোমারের দুই মহাকাব্য ইলিয়াড এবং ওডিসির রচনাকাল আনুমানিক ৭৫০-৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এই দুই মহাকাব্যে দাসত্ব এবং দাসপ্রথার টুকরো কিছু ছবি পাওয়া যায়। কৃষি এবং শিল্প খাতে শ্রমের চাহিদা মেটানো হতো দাসদের দিয়ে। গ্রিকদের শিল্প যখন সমুদ্র পার হয়ে রফতানি শুরু হয় তখন দাসদের প্রয়োজনীয়তাও বৃদ্ধি পায়। দাস বেচাকেনার জন্য ব্যবসা শুরু হয়। এথেন্সের দাস ব্যবসায়ীরা এশিয়া মাইনর, সিরিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে দাস আমদানি করত। ফিনিসীয় দাস ব্যবসায়ীরা নিজেরাই এথেন্সের বাজারে দাস নিয়ে আসত। সিরিয়া, মিসর, আরব প্রভৃতি দেশের সঙ্গেও এথেন্স এবং অন্য গ্রিক রাষ্ট্রের দাস ব্যবসা শুরু হয়। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে এথেন্সের অর্থনীতি পুরোপুরিই দাসশ্রমনির্ভর হয়ে পড়ে। প্রাচীন রোম সভ্যতাতেও ছিল দাসপ্রথার প্রচলন। রোমান সাম্রাজ্যের বিজিত প্রদেশগুলো থেকে রোমে দাস সরবরাহ করতে হতো। দাসদের কাহিনী কিন্তু অনেক বড়। লিখছি অনেক বই পড়ে, নানা লেখকের প্রবন্ধ দেখে আর ইন্টারনেটের ইতিহাস পড়ে। এরসাথে মিশিয়েছি নিজের কিছু ভাষা। জানি না কেমন হচ্ছে। আরও কয়েকটি পর্ব লিখবো। লিখতে হবে দাস বিদ্রোহের কথা, লিখবো একজন স্পার্টাকাসের কাহিনী। (চলবে)
লেখক- সাংবাদিক ও কলাম লেখক।