তাহাজ উদ্দিন/
খৃষ্টের জন্মের পর পৃথিবী এক হাজার নয়শো চুয়াত্তর বার সূর্যকে প্রদক্ষিণ শেষ করে পরবর্তী প্রদক্ষিনে মাঝরাস্তা অতিক্রম করে কিছুটা পথ এগিয়েছে। সেই পরিক্রমণকালে পৃথিবী ঠিক আজকের যায়গায় ছিল ১৫ই আগষ্ট ‘৭৫ এ। পৃথিবী তার স্বাভাবিক গতিতেই চলমান কিন্তু হটাৎ করে সব শুন্য হয়ে গেল বাঙালি জাতির জীবনে। অত্যন্ত অশুভ সেই ভোর, অশুভ সেই সকাল, সেই সূর্য আবির্ভূত হ’ল আমাদের সকল অর্জন, সকল অগ্রগতি, সকল আশা আকাঙ্ক্ষা নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে। আমাদের ইতিহাস, আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের সভ্যতা এবং আমাদের বেঁচে থাকার সকল কিছুকে ধ্বংসের ঘৃণ্য চক্রান্ত বাস্তবায়নে হত্যা করা হ’ল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে, আমাদের জনককে, বাংলায় জন্ম নেয়া সেই মহা-মানবকে। বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের ২১৮ বছর পরে স্বাধীন বাংলার পবিত্র সিংহাসন কলঙ্কিত করে সেখানে আরোহন করল শতাব্দীর ঘৃণ্য প্রতিক্রিয়াশীল ষড়যন্ত্রকারী বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক।
দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক, প্রতিক্রিয়াশীল ঘৃণ্য পিশাচরা সর্ব কালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক, তাঁর সহধর্মিণী, সন্তান, পুত্রবধূ, আত্মীয় বন্ধু সহ সহকর্মীদের প্রাণ কেড়ে নিয়েই বিরত থাকল না – সাথে সাথে হিংস্র হায়েনার অশুভ থাবা বিস্তার করে জাতির কন্ঠ রোধ ও ক্ষতবিক্ষত করার মাধ্যমে এক অরাজক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির জন্ম দিল। অবর্ননীয় সেই বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে কারা প্রচিরের নিরাপদ সেলে সেই ঘৃণ্য পশুরা অত্যন্ত নিষ্ঠুর, নির্দয় ভাবে হত্যা করল জাতীয় চার নেতাকেও।
তারপর সেই দস্যু আততায়ী, ঘাতকদের নুন্যতম তিরস্কার, দন্ডিত না করে নানা ভাবে তাদেরকে পুরস্কৃত করে মানুষের ভাবনা আর বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসের বুক বিদ্ধ করে দিল স্থায়ী কলঙ্কের পেরেক বসিয়ে। ঘাতকদের পুরস্কার হিসাবে সরকারি উচ্চ পদে আসীন করেই থামেনি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রকারীরা, ইনডেমনিটি বিল পাশ করে সমস্ত দায় থেকেও এককালীন অব্যহতি নিশ্চিত করে তাদের। দুনিয়ার কোন সভ্য বা অসভ্য দেশ বা সমাজে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে এমন নজির নাই – যা দেশদ্রোহী ঘৃণ্য এই ঘাতকদের পৈশাচিকতার সাথে তুলনীয় হতে পারে।
মানব আকৃতির হিংস্র সেইসব জানোয়ারের হুংকারে ভীত সন্ত্রস্ত সমাজ জীবন। বাংলার স্বাধীনতা লাভের পর সভ্যতা সহ অগ্রগতির জাগ্রত সমস্ত চেতনা ভুলুন্ঠিত। সরকারি বেসরকারি সকল ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ নিষিদ্ধ। বিকট বিভীষিকাময় অরাজক সেই পরিস্থিতির চাক্ষুষ যারা – জীবনকাল ব্যাপী সেই আতঙ্ক তাদেরকে তাড়া করে চলেছে।
অভিশপ্ত সেই সকাল শুরুর সাথে সাথেই গোটা দেশ, প্রকৃতি নির্বিকার স্তম্ভিত। জাতি সেই করুন হতবাক অবস্থার মাঝেই রেডিওতে বিরতিহীন ধর্মের বানী প্রচার শুনে চলেছে। একাত্তরের গনহত্যাও ধর্মের নামেই চালানো হয়েছিল। একাত্তর আর পঁচাত্তরের খুনীরা ঐদিন ছিল একাকার। অশুভ সেই ঘৃণ্য অপশক্তি ঐদিন একাকার হয়েই বিদীর্ণ করল ছাপান্ন হাজার বর্গ মাইলের সমান জনকের বিশাল সেই হৃদয় সাথে বিদীর্ণ হ’ল বাংলার হৃদয়। থেমে গেল আমাদের প্রগতি, উৎকর্ষতা, সভ্যতা,মূল্যবোধ সহ সকল আশা আকাঙ্ক্ষার চাকা।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্যে দিয়া মূলত তাঁর আদর্শের কবর রচনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং মূল্যবোধ মুছে ফেলা এবং ধর্ম নিরপেক্ষ শোষণহীন সমাজ বিনির্মানের পথকে চিরতরে রূদ্ধ করে ক্রমান্বয়ে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ও স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতক দালালদের বাংলার মাটিতে স্থায়ী পুনর্বাসনের মাধ্যমে তাদের রাজনীতির সুযোগ করে দেয়। কুচক্রী কুশীলবরা ২১ বছরব্যাপী সে অপচেষ্টাতেই লিপ্ত ছিল বাধাহীনভাবে। পর্দার আড়ালে সেই হীন জঘন্য চক্রান্ত আর অপচেষ্টাই এখনও লিপ্ত হায়েনার দল।
‘৭৫ এর ১৫ই আগষ্টের পর সরকারি বেসরকারি ভাবে সকল জাতীয় দিবস পালিত হয়েছে। রেডিও টিভিতে এসম্পর্কিত অনুষ্ঠান বিরতিহীন ভাবে প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু জাতীয় দিবস সমূহ অর্জিত যাঁর নামে তথা স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, চুড়ান্ত বিজয় এবং সকল অর্জনের জনক যিনি তাঁর নামটি একবারের জন্যও উচ্চারিত হয়নি। আমরা হাহাকার করেছি গোপনে এবং প্রকাশ্যে। এজন্য অনেককে নানাভাবে নিগৃহীত হতে হয়েছে। বুকের এহেন রক্তক্ষরন জাতি ভুলবে কিভাবে!।
পৃথিবীতে এমন একটিও নজির নাই – যেখানে জাতির শ্রেষ্ঠতর মানুষটিকে হত্যা করে খুনীরা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে বলে ‘ আমরাই হত্যাকারী, আমরাই খুনী, আমরাই খুন করেছি ‘। অরাজকতার এমন দৃষ্টান্ত দুনিয়ায় কোথাও কোন কালে নিকৃষ্ট কোন শয়তানের দ্বারাও সৃষ্টি হয় নাই। নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারীরা বিদেশি প্রভু আর অস্ত্রের জোরে এমন পরিস্থিতিই তৈরি করে রেখেছিল জনক হত্যার পরের দীর্ঘ সময়।
ভালবাসা আর দয়ার সাগর বঙ্গবন্ধু তাঁর অপার দয়ায় রাজাকারদের যেমন ক্ষমা করেছিলেন তেমনি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রকারী খন্দকার মোশতাককেও ক্ষমা করে মন্ত্রী সভায় ঠাঁই দিয়েছিলেন। বিশ্বাসঘাতকের প্রতি এই দয়া আর ক্ষমার প্রতিদান জীবন দিয়ে শোধ করতে হ’ল বঙ্গবন্ধুকে।
বঙ্গবন্ধুর প্রানের দেশ, প্রানের বাঙালি, এদেশের সমস্ত মানুষ তাঁর সন্তানসম, সেই তাঁর প্রানের দেশে, প্রানের মানুষদের দ্বারা, সন্তানসম সকলের মাঝে তাঁকে হত্যা করা হবে ! এর চাইতে অবাস্তব, অসম্ভব, অকল্পনীয় আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু অকল্পনীয় ভাবেই এই বাংলায় স্বগৃহে সপরিবারে শ্রেষ্ঠতর এই মানুষটিকে হত্যার ষড়যন্ত্রের সাহস আর সুত্রপাত কখন এবং কোথা হতে, তা জানা এবং পরিপূর্ণ ভাবে উদঘাটন করা একান্ত দায় এই জাতির।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ৫৫ বছরের সমস্ত সত্ত্বা, অস্তিত্ব আর বুকের রক্ত দিয়ে আমাদের জন্য রেখে গেছেন মহাকল্যানকামী আদর্শ আর বিজয়ের অস্ত্র। সেই আদর্শ ধারণ করে অপরাজেয় অস্ত্র পুরোপুরি হাতে তুলে নিতেই হবে এ জাতিকে। তবেই দূর্নীতি, বৈষম্য, সুবিধাবাদ, নানা অনাচার সহ সকল বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলে সত্যিকার কল্যানকামী রাষ্ট্র আর সমাজ বিনির্মান সম্ভব হবে। তাই আজকের এই শোকের দিন, জয় করার দৃঢ় অঙ্গিরার আর প্রতিজ্ঞার দিনে পরিনত হোক।
দেশ, মাটি, মানুষের সাথে বঙ্গবন্ধুর অমলিন, অকৃপণ যে বন্ধন তার একটি সামান্য ঘটনা উল্লেখ করছি তাঁর প্রয়ান দিনে–
জেলা নেতাদের দলীয় এক সভায় এক নেতা বিনয়ের সাথে বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, গণভবনে না থেকে ধানমন্ডির অরক্ষিত বাড়িতে থাকেন কেন ‘! বঙ্গবন্ধু হয়তো প্রশ্নটির গুরুত্ব দিয়েই বলেছিলেন ” আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী আর দেশদ্রোহীরা হয়তো আমার বিরুদ্ধে লেগেছে, যে কোনো সময় আমাকে আঘাতও করতে পারে। কিন্তু সে সুযোগ আমি তাদের দেব না। যদি পহেলা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যেতে পারি এবং দেশের জন্য নতুন সিস্টেম চালু করতে পারি। আর তার আগেই যদি মরে যাই তোরা এক কাজ করিস। বাংলার কোন গ্রামে, ধানখেতের পাশে কিংবা বাঁশবাগানে আমার কবর দিস। কবরে শুয়ে যেন বাংলার মাটির স্বাদ পাই। বাংলার পাখির গান শুনি আর বাংলার সোনালী ধানের ঘ্রাণ পাই। কোন স্মৃতি স্তম্ভ নয়- আমার কবরে একটি চোঙ্গা বানিয়ে রেখে দিস “। একজনের বিনীত প্রশ্ন ছিল চোঙ্গা দিয়ে কি হবে, স্যার ! বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ” বাংলার মানুষ যুগ যুগ ধরে দেখবে শেখ মুজিব নামে একটি লোক একদিন টিনের চোঙ্গা হাতে নিয়ে বাংলার রাজনীতিতে নেমেছিল। সারা জীবন বাঙালি বাঙালি বলে চিৎকার করে করে একদিন সেই চোঙ্গা হাতে নিয়েই সে পৃথিবী থেকে চলে গেছে”।
বাংলা আর বাংলার মানুষই যাঁর সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে, তাই আমাদের একমাত্র ভরসাই ছিল যে মানুষটি, আমাদের সেই অস্তিত্ব আর ভরসাকে যে ঘৃণ্য পিশাচ হায়েনার দল এত নিষ্ঠুর, নির্মম ভাবে হত্যা করল, ধিক্কার জানাই সেই ঘৃণ্য প্রতিক্রিয়াশীল নরপশুদের, ধিক্কার জানাই এই বাংলায় তাদের জন্মের। বাঙালি জাতির কালের যাত্রা অবধি ধিকৃত, ঘৃণিত হতেই থাকবে ঔ নিষ্ঠুর পিশাচের দল এবং তাদের উত্তরসূরী।